পাখি কেন গায়

গান শিখতে চান? গান শেখার জন্য গুরু খুঁজছেন? তবে গানের প্রাকৃতিক গুরুর কাছে তালিম নিতে পারেন বিনে পয়সায়। বলছিলাম গানের পাখিদের কথা। ভোর–সকালে পাখির কূজন বা গভীর নিস্তব্ধ রাতে প্যাঁচার ডাক, যেটাই হোক না কেন, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি নানা সময়ে আপনাকে নানা ঘরানার গান শুনিয়ে যাবে। অবশ্য ইট-কাঠের শহরে কাকের কর্কশ কা কা একটু বেশি শোনা গেলেও মধুকণ্ঠী পাখির দেখা যে একেবারেই মেলে না, তা কিন্তু নয়। একটু মনোযোগ দিয়ে কান পাতলেই ঋতু পরিক্রমায় তাদের সুমিষ্ট গানের শ্রোতা হওয়া সম্ভব।

কিন্তু পাখিরা আসলে গান করে কেন? এটাই কি তাদের যোগাযোগের ভাষা? এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ অনেক পাখি প্রজাতির মধ্যে শুধু পুরুষ পাখিরাই গান গাইতে পারে, স্ত্রী পাখিদের স্বরই তৈরি হয় না। আবার পুরুষ পাখিরাও ১২ মাস আপনার জন্য গান গেয়ে বেড়াবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। শুধু প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী পাখিদের আকর্ষণ করার মধ্যেই তাদের সংগীতচর্চা সীমাবদ্ধ। যে পুরুষ পাখির কণ্ঠ যত সুরেলা, সে তত বেশি আকর্ষণীয় তার স্ত্রী পাখিদের কাছে। স্ত্রী পাখিরাও কম যায় না। সঙ্গী নির্বাচনে তারা বেশ খুঁতখুঁতে। স্ত্রী পাখির মন বোঝাও দায়। একেক পাখির একেক রকম চাহিদা। কোনো কোনো স্ত্রী পাখির কেবল সুরেলা গান শুনে মন ভরে না। তাদের চাই সুউচ্চ কণ্ঠে গান! যে পুরুষ পাখিটি যত জোরে গান গাইতে পারবে, তার সম্ভাবনা তত বেশি। ছোট ডানাওয়ালা প্রিনা পাখির কথাই ধরুন। মাত্র ৯ দশমিক ৪ গ্রাম ওজন নিয়ে সে নাকি কাকের চেয়েও ১০ গুণ জোরে ডাকতে পারে। কোনো কোনো পাখি হাজারের বেশিসংখ্যক সুরে গান বাঁধতে পারে। আবার আমাদের পরিচিত চড়ুইয়ের কেবল এক রকম গানই জানা আছে। সুরবাহার বা বীণা পাখি খুব জটিল স্বরলিপিতে গান গায়। পুরুষ ফিঞ্চ পাখিরা ভালো গান গাওয়ার জন্য ৫০ দিন পর্যন্ত গানের চর্চা করে স্ত্রী পাখির সামনে গান পরিবেশন করে! তাহলে বুঝতেই পারছেন! পাখির ক্ষেত্রেও সিঙ্গেল থেকে ডাবল হওয়া অত সোজা নয়! অনেক যাচাই-বাছাই আর কঠোর সংগীত সাধনার পর তৈরি হয় এক জোড়া পাখির সফল জুটি।

গানে গানে যুদ্ধও লেগে থাকে পাখিদের মধ্যে। নাইটিঙ্গেল বা বুলবুলি পাখিরা গান গেয়ে নিজেদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে থাকে, তার এলাকায় আর কোনো বুলবুলিকে ঘেঁষতে দেয় না সে।
আরও পড়ুন

জুটিবদ্ধ হতেই যে পাখিরা শুধু গান গায়, তা নয়। বরং আধিপত্য বিস্তারের প্রতীক হিসেবে গানকে ব্যবহার করে দোয়েল–জাতীয় পাখিরা। যে এলাকাজুড়ে তাদের কণ্ঠ শোনা যাবে, সে এলাকাকে নিজের এলাকা বলে ঘোষণা করে তারা। এভাবে অন্য পাখিদের সতর্ক করে, যাতে যত দূর পর্যন্ত তাদের ডাক শোনা যায়, সেখানে অন্যরা না ভেড়ে। এভাবে স্বঘোষিত এলাকায় নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করে তারা। যেহেতু তাদের গানের সঙ্গে নিজের এলাকা রক্ষার ব্যাপার জড়িত, তাই নির্দিষ্ট কোনো মাস নেই গান গাওয়ার জন্য, সারা বছরই তারা গান গেয়ে যায়।

গানে গানে যুদ্ধও লেগে থাকে পাখিদের মধ্যে। নাইটিঙ্গেল বা বুলবুলি পাখিরা গান গেয়ে নিজেদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে থাকে, তার এলাকায় আর কোনো বুলবুলিকে ঘেঁষতে দেয় না সে। এমন শক্ত–সমর্থ পুরুষ যোদ্ধাদের খুব পছন্দ করে স্ত্রী বুলবুলিরা। তাই নাইটিঙ্গেল নাম হলেও দিনে–রাতে সব সময় গান গেয়ে যে বাসস্থান সুরক্ষিত রাখতে পারে, তাকেই বেছে নেয় স্ত্রী বুলবুলি।

পাখিদের মধ্যেও নকল করার প্রবণতা দেখা যায়। ভালো সুর পেলে অন্য জাতের পাখিদের মতো গাইতে শুরু করে। নর্দার্ন মকিংবার্ড এক ডজনেরও বেশি ভিন্ন রকম পাখির সুরে গান ধরতে পারে। লায়ারবার্ড এতটাই নিখুঁতভাবে স্বর নকল করতে পারে যে কিছুতেই তাকে আসল পাখি থেকে আলাদা করা যায় না।

চড়ুই পাখি
ছবি: রাকিন জহির
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের চড়ুই পাখিরা নিজেদের শক্ত ঠোঁটজোড়া একটা আরেকটার সঙ্গে ঠুকে ছন্দের তালে তালে শব্দ করে। সেই সঙ্গে সুরেলা কণ্ঠ তো আছেই।

উত্তর আমেরিকা কার্ডিনাল পাখিদের যেমন আকর্ষণীয় ঝুঁটি আর ঠোঁট থাকে, তেমনি অভিনব তাদের গায়কী। এরা আবার যেমন–তেমন আউল–বাউল গান গায় না। স্বরলিপি ধরে ধরে তাল–লয় মেপে মেপে রীতিমতো শাস্ত্রীয় সংগীত গায় এরা। তাদের গানের ছন্দ নাকি আবার আধুনিক লেজার বিমের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে মিলে যায়। এমন শুদ্ধ সংগীতের আসর বসাতে চাইলে সূর্যমুখীর বীজ দিয়ে আকৃষ্ট করতে পারেন একদল কার্ডিনালদের। পছন্দের খাবার খেতে খেতে এরা আপনাকে গান শুনিয়ে দেবে।

শুধু খালি গলায় সুর দিয়ে গান গাইলে কি আর চলে? ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের চড়ুই পাখিরা নিজেদের শক্ত ঠোঁটজোড়া একটা আরেকটার সঙ্গে ঠুকে ছন্দের তালে তালে শব্দ করে। সেই সঙ্গে সুরেলা কণ্ঠ তো আছেই। সুর আর বাদ্যের এক অপূর্ব মিশ্রণে তারা তৈরি করে গান গায়। এমন বাদ্যবাজনা শুনে স্ত্রী চড়ুই মুগ্ধ হতে বাধ্য।

পাখিরা উড়তে উড়তেও গান গায়। উড্ডয়ন সংগীতের মূর্ছনায় সঙ্গীসাথি পাখিদের জড়ো করে একসঙ্গে নেচে নেচে উড়ে বেড়ায়। প্রায় এক ঘণ্টা টানা উড়ে গান গাইতে পারে তারা। উড়ে উড়ে গান গাওয়ার সময় নিজের সীমানা নির্ধারণ করে।

সূত্র: হাউ ইট ওয়াকর্স ম্যাগাজিন

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন