বিশ্বের দ্রুততম প্রাণী

পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণীদের কাছে গতি মানে বেঁচে থাকা। প্রাণীদের মধ্যে তো আর অলিম্পিক নেই যে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে! ফলে প্রাণীদের দ্রুত দৌড়ানো মানে হয় শিকার করা, নয়তো জীবন বাঁচানো। আগেই বলেছি, প্রাণীদের গতির কোনো অলিম্পিক নেই। তাই এদের গতি পর্যবেক্ষণ করতে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে মানুষ। সব সময় গতি একরকম পরিমাপ করা যায় না, কম-বেশি হয়। তা ছাড়া স্থলে যেমন প্রাণীদের জীবন বাঁচাতে বা শিকার করতে হয়, একই কাজ করতে হয় পানি বা আকাশেও। তাই এখানে জল, স্থল ও আকাশের সবচেয়ে দ্রুতগামী ৩টি করে প্রাণীকে নিয়ে আলোচনা করব—ক্রমান্বয়ে তৃতীয় দ্রুততম থেকে দ্রুততম প্রাণীর কথা আসবে একে একে। চলুন, শুরু করা যাক।

স্থলের দ্রুততম প্রাণী

৩. উটপাখি

উটপাখি ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখিগুলোর মধ্যে অন্যতম। পাখি হলেও এরা উড়তে পারে না। সে হিসাবে স্থলের সবচেয়ে বড় পাখিও বলা যায় একে। উটপাখি ৯ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে, দৌড়ানোর সময় প্রতিটি পদক্ষেপে যেতে পারে ১০ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত। বনের রাজা সিংহের মতো প্রাণীরাও এদের ভয় পায়। কারণ উটপাখির লাথিতে সিংহ পর্যন্ত কাবু হয়ে পড়ে।

উটপাখির বৈজ্ঞানিক নাম স্ট্রুরিও ক্যামেলাস (Struio camelus)। বেশির ভাগ উটপাখি পশ্চিম আফ্রিকার মৌরতানিয়া এবং সেনেগালের মতো দেশসহ আফ্রিকার অনেক সমভূমি ও বনভূমিতে বাস করে। জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকায়ও দেখা যায় এ পাখি। 

২. প্রংহর্ন

ছবি: ইয়াথিন কৃষ্ণাপ্পা

দেখতে হরিণের মতো হলেও এরা আসলে হরিণজাতীয় প্রাণী নয়। এদের নিকটতম জীবিত আত্মীয় জিরাফ। ঘণ্টায় ৯৭ কিলোমিটার গতিতে ছুটে এরা শিকারিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। শুধু পালাতেই নয়, এই বেগে দৌড়ে এসে এরা শিকারকে আঘাতও করে। উত্তর আমেরিকায় এর চেয়ে বেশি গতির তো দূরের কথা, গতির দিক থেকে এর ধারে-কাছেই নেই কোনো প্রাণী। বলে রাখি, এটি স্থলের দ্বিতীয় দ্রুততম প্রাণী।

আকারে খুব বেশি বড় নয়। লেজ থেকে নাক পর্যন্ত ৪.৩ ফুট থেকে ৪.১১ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ফলে এরা যখন ৬০ কিলোমিটার বা আরও বেশি গতিতে ছোটে, প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। মনে হয় সাদা কোনো বিন্দু ছুটে যাচ্ছে। ওজন হতে পারে ৪০ থেকে ৬৫ কেজি পর্যন্ত। খাবারের সন্ধানে এরা সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যান্টিলোকাপ্রা আমেরিকানা (Antilocapra americana)। 

আরও পড়ুন

১. চিতা 

চিতা সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী, এ কথা কম-বেশি সবার জানা। তবে শুধু স্থলের দ্রুতগামী প্রাণী এরা। সব মিলিয়ে বিশ্বের দ্রুততম প্রাণীর দেখা পেতে আরও কিছুটা ধৈর্য্য ধরতে হবে।

চিতার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাসিনোনিক্স জুবাটাস (Acinonyx jubatus)। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় মূল আবাসস্থল। তবে এশিয়া মহাদেশের ইরানেও কিছু চিতা দেখা যায়। আফ্রিকান এই বন্য বিড়ালজাতীয় প্রাণী ঘণ্টায় প্রায় ৯৬-১১২ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। তবে চিতার গতিবেগ আসলে কত, তা হিসাব করা বেশ কঠিন কাজ।

একবার এক চিড়িয়াখানার কর্মী তাঁর গাড়ির পেছনে মাংস ঝুলিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করেন। সেটা দেখে চিতা দেয় দৌড়। এ সময় ওই চিতা ঘণ্টায় ৯৬ কিলোমিটার বেগে ছুটছিল। চিড়িয়াখানার ওই কর্মীর মতে, চিতা ৩ সেকেন্ডে ০ থেকে ৯৬ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি চিড়িয়াখানার সারাহ নামে একটি চিতা ৫.৯৫ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড করেছিল। এত দ্রুত ছোটার পেছনে মূল ভূমিকা রাখে এর শারীরিক গঠন। প্রায় ৬০-৭০ সেন্টিমিটার লম্বা লেজ, দীর্ঘ ও নমনীয় মেরুদণ্ড (যা ইচ্ছেমতো বাঁকাতে পারে চিতা), বিশাল ফুসফুস, দীর্ঘ পা ইত্যাদি মিলে চিতা হয়ে উঠেছে স্থলের দ্রুততম প্রাণী।

এবারে মানুষের সঙ্গে চিতার একটু তুলনা করে দেখা যাক। পৃথিবীর দ্রুততম মানব উসাইন বোল্ট। ২০০৯ সালে তিনি ৯.৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়েছিলেন। সে হিসাবে তাঁর গতিবেগ ঘণ্টায় ৪৪.৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ চিতার চেয়ে প্রায় অর্ধেক। যা-ই হোক, পৃথিবীতে খুব বেশি চিতা আর বেঁচে নেই। আইইউসিএন-এর মতে, পৃথিবীতে আর মাত্র আট হাজার চিতা জীবিত আছে।

দ্রুততম জলজ প্রাণী

৩. সেলফিশ

ছবি: ব্রিটানিকা

পৃথিবীর দ্রুততম জলজ প্রাণীগুলোর একটি সেলফিশ। সমুদ্রের পানি ঠেলে এরা ঘণ্টায় প্রায় ৩০-১০০ কিলোমিটার বেগে এগোতে পারে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ সেলফিশের এই গতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইতালির ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের ইনস্টিটিউট অব বায়োফিজিকসের জীববিজ্ঞানী পাওলো ডোমেনিচি। তাঁর মতে, সেলফিশ এতটা দ্রুত ছুটতে পারার কথা নয়। এরকম সন্দেহ করার উপযুক্ত কারণও রয়েছে। সেলফিশের ১০০ কিলোমিটার গতিতে ছোটার ব্যাপারটা প্রচলিত হয় ১৯৪১ সালে কান্ট্রি লাইফ ম্যাগাজিন-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে। বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো জার্নালে এ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। তাই তথ্যটি প্রশ্নবিদ্ধ। 

তাঁর মতে, মাছ কতটা দ্রুত ছুটতে পারে, তা পরিমাপের জন্য এখন পর্যন্ত ভালো কোনো পরিমাপক নেই। তবে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে সেলফিশের গতি পরিমাপের চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য তাঁরা টেইলবিট ফ্রিকোয়েন্সি পরিমাপ করতে মাছের ভিডিও করেন। টেইলবিট মানে, মাছ যে কম্পাঙ্কে লেজ নাড়ে। এটি মাছের গতির সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে সম্পর্কিত। যাই হোক, এই টেইলবিট থেকে তাঁরা সেলফিশের গতি পান ঘণ্টায় ৩৬ কিলোমিটার। তবে এই পদ্ধতিও কতটা সঠিক, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। 

প্রাপ্তবয়স্ক সেলফিশ সর্বোচ্চ দেড় মিটার লম্বা হয়। নীল রঙের এই মাছের ওজন হতে পারে প্রায় ৪৫ কেজি। ভারত মহাসাগরের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল এ মাছের প্রধান আবাসস্থল। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ইস্টিওফরাস প্লাটিপ্টেরাস (Istiophorus platypterus)। 

২. সোর্ডফিশ

ছবি: জেফ রোটম্যান

সোর্ডফিশের মুখের সামনে তলোয়ারের মতো একটা সুচালো অঙ্গ আছে। এ জন্যই এর নাম সোর্ডফিশ। ঘণ্টায় ৩৬-১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে এরা। প্রথম সোর্ডফিশের গতির পরিমাপ করেন রুশরা। ১৯৬০-এর দশকে একটি প্রবন্ধে উঠে আসে বিষয়টি। তবে এই পরিমাপ তাঁরা কীভাবে করেছিলেন, তার বিবরণ খুব স্পষ্ট নয়। ২০০৭ সালে জার্নাল অব দ্য রয়েল সোসাইটি ইন্টারফেস-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ঘণ্টায় ৫৪ কিলোমিটারের বেশি বেগে সাঁতার কাটলে মাছের পাখনায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রচুর। এর সঙ্গে মিলিয়ে জীববিজ্ঞানী ডোমেনিচ বলেন, সোর্ডফিশের গতি ঘণ্টায় ৩৬ কিলোমিটারের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

২০১৬ সালে জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, সোর্ডফিশ চলার সময় মাথার ছিদ্র থেকে তেল নিঃসরণ করে। এ থেকে একটি তৈলাক্ত স্তর তৈরি হয়। এ কারণেই মাছটির গতি হ্রাস পায়। তবে সব মিলিয়ে ঘণ্টায় ৩৬ কিলোমিটার গতি হলেও এরা বিশ্বের দ্রুততম মাছের তালিকায় থাকবে। 

১. ব্ল্যাক মার্লিন

ছবি: জুলিয়া বাহলসেন

ব্ল্যাক মার্লিনকে সবচেয়ে দ্রুততম সামুদ্রিক প্রাণী হিসেবে ধরা হয়। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী বিবিসি সায়েন্স ফোকাস-এর তথ্যানুসারে, এরা ঘণ্টায় প্রায় ১২৯ কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটতে পারে। তবে এই গতি কীভাবে পরিমাপ করা হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে কোথাও বলা নেই। ২০১৬ সালে ডোমেনিচের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এদের গতি ঘন্টায় ৩৬ কিলোমিটার। সাধারণত আটলান্টিক, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে এদের পাওয়া যায়। ১৫ ফুটের মতো লম্বা এ মাছ প্রায় ৮০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। ব্ল্যাক মার্লিনের বৈজ্ঞানিক নাম ইস্টিওমপ্যাক্স ইন্ডিকা (Istiompax indica)।

আরও পড়ুন

আকাশের দ্রুততম প্রাণী

৩. ব্রাজিলিয়ান বাদুর

ছবি: উইকিমিডিয়া

২০১৬ সালে রয়েল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ব্রাজিলিয়ান ফ্রি-টেইলড বাদুড় সেকেন্ডে ৪৪.৫ মিটার উড়তে পারে। সে হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় এদের গতি হয় ১৬০ কিলোমিটার। গবেষণায় কিছু স্ত্রী বাদুড় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এদের গড় ওজন প্রায় ১২ গ্রাম। 

তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, এই বাদুড়ের চেয়ে হোয়াইট-থ্রোটেড নিডলটেল পাখি আরও বেশি দ্রুত উড়তে পারে। ঘণ্টায় এ পাখির গতি ১৬৯ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয়নি এখনো। তাই ব্রাজিলিয়ান বাদুড়কেই আপাতত আকাশ পথের তৃতীয় দ্রুতগামী প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করতে হয়। 

তবে এ বাদুড় যে শুধু ব্রাজিলেই পাওয়া যায়, তা নয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-এর মতে, দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা ও চিলি থেকে শুরু করে মধ্য আমেরিকার ওরেগন থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত এ বাদুড়ের আবাস। এদের বৈজ্ঞানিক নাম টাদারিডা ব্রাসিলিয়েনসিস (Tadarida brasiliensis)। 

২. গোল্ডেন ঈগল

ছবি: উইকিমিডিয়া

গোল্ডেন ঈগল উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম পাখিগুলোর একটি। এদের ডানার বিস্তার প্রায় ৭ ফুটের বেশি। আকারে অনেক বড় হলেও এরা দ্রুত উড়তে পারে। কিন্তু যখন ডাইভ দেয়, তখন দেখা যায় এদের সর্বোচ্চ গতি। নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্নেল ল্যাব অব অরনিথোলজি অনুসারে, অনেক ওপর থেকে ডাইভ দেওয়ার সময় গোল্ডেন ঈগলের গতি হয় ঘণ্টায় প্রায় ৩২২ কিলোমিটার।

সাধারণত শিকার ধরতে ডাইভ দেয় এরা। তবে অনেক সময় খেলার ছলেও ডাইভ দেয়। আইইউসিএন অনুসারে, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়াসহ উত্তর গোলার্ধজুড়ে বাস করে গোল্ডেন ঈগল। এরাই ঈগল প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী ও বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুততম প্রাণী। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাকুইলা ক্রাইসেটোস (Aquila chrysaetos)।

১. পেরিগ্রিন ফ্যালকন

বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম প্রাণী পেরিগ্রিন ফ্যালকন। শুধু পাখিদের মধ্যে নয়, পৃথিবীর সব প্রাণীদের মধ্যেই দ্রুততম। সাধারণত আমরা ভাবি, চিতা সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী। কিন্তু পেরিগ্রিন ফ্যালকন তার চেয়েও প্রায় সাড়ে তিন গুণের বেশি দ্রুতগামী। এরা ডাইভ দেওয়ার সময় ৩৫৪ কিলোমিটার গতিতে ওপর থেকে নিচে নেমে আসতে পারে। শিকার কিছু বুঝে ওঠার আগেই এদের কব্জায় চলে আসে। দুই পায়ের ধারালো নখের সাহায্যে আটকে রাখে শিকারকে। তবে অনেক দ্রুত গতিতে ডাইভ দিলেও এদের সাধারণ ওড়ার গতি অনেক কম, ঘণ্টায় ৬৪-৯৭ কিলোমিটার। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর মতে, পেরিগ্রিন ফ্যালকনের রেকর্ডকৃত গতি ঘণ্টায় ৩৮৯ কিলোমিটার।

প্রথম দেখায় এদের কাক মনে হতে পারে। তবে কাক ভেবে ভুল করে বসলে বিপদ। এরা মাঝেমধ্যে মানুষকেও আক্রমণ করে! বিশেষ করে প্রজনের সময়। প্রধানত এদের অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া গেলেও অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া মোটামুটি সব মহাদেশে কম-বেশি দেখা যায়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম ফ্যালকো পেরেগ্রিনাস (Falco peregrinus)।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও বিবিসি সায়েন্স ফোকাস

আরও পড়ুন