বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে কী হতো

বাতাসে অক্সিজেনের অনুপাত বেড়ে গেলে পোকামাকড়ের আকার হতো বড়। বেড়ে যেত আগুন লাগার ঘটনা? কেন? বাড়তি অক্সিজেনের কারণে আমরা কি কোনো বাড়তি সুবিধা পেতাম? নাকি উল্টো বিপদ ডেকে আনত? জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অক্সিজেনের পরিমাণ বাতাসে দ্বিগুণ হলে কী হতো, আসুন বিষয়টা একটুখানি ভেবে দেখা যাক!

অক্সিজেনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই গ্যাস আগুন জ্বালাতে দারুণভাবে সাহায্য করে

প্রতিদিন আমরা কতবার শ্বাস নিই, বলতে পারেন? প্রায় ২৩ হাজার বার! মস্তিষ্ক ও দেহকোষে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখতেই আমরা এতবার শ্বাস নিই। কারণ, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মজার বিষয় হলো, আমরা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যে বাতাস টেনে নিই, তাতে অক্সিজেন থাকে খুব সামান্য পরিমাণে। মাত্র ২০ শতাংশের মতো। অন্যদিকে নাইট্রোজেন থাকে প্রায় ৭৮ শতাংশ। আর বাকি ২ শতাংশ অন্যান্য গ্যাস ও ধূলিকণা। এই ২০% অক্সিজেন দিয়েই আমাদের কাজ চলে যায়। কিন্তু এ পরিমাণটা বেশি হলে কী হতো?

মানবদেহের প্রায় ৯০ শতাংশ শক্তি আসে অক্সিজেন থেকে। ১০ শতাংশের জন্য আমরা খাদ্য ও পানীয়ের ওপর নির্ভরশীল। অক্সিজেন ছাড়া এই লেখাটি আপনি পড়তে পারতেন না। আসলে কিছুই করতে পারতেন না। বেঁচে থাকলে তো করবেন! শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন আবশ্যক।

অথচ, এই অক্সিজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটত আমাদের চারপাশে। দেখা মিলত দৈত্যাকার সব পোকামাকড়ের। ভাবছেন, কীসের মধ্যে কী! অক্সিজেনের সঙ্গে পোকামাকড় বড় হওয়ার সম্পর্ক কোথায়? আছে, সম্পর্ক আছে। পোকামাকড় শ্বাস নেয় ট্রাকিয়া নামের ক্ষুদ্র একটা নলের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই নলে অক্সিজেন বেশি ঢুকলে বেড়ে যাবে পুরো দেহের আকার। ফলে মাকড়শা কিংবা আরশোলার মতো কীটপতঙ্গ এখনকার চেয়ে কয়েকগুণ বড় হয়ে উঠবে।

অতিমানবীয় শক্তি, প্রখর ইন্দ্রীয় আর রোগবালাই থেকে দূরে থাকতে চাওয়া মানুষের চিরকালের। সেটাই পাওয়া যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন দ্বিগুণ হলে। কিন্তু এর বিনিময়ে কী খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে? মানে, এসবের সাইড এফেক্ট কী?
বাতাসে অক্সিজেন বাড়লে কীটপতঙ্গের দেহের আকার হতো দানবীয়
উইকিমিডিয়া

প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি বছর আগে, অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আজকের মতো ছিল না। তখন বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। পোকামাকড়ের আকারও ছিল আজকের তুলনায় অনেক বড়। ড্রাগন-ফ্লাই বা ফড়িংয়ের আকার ছিল প্রায় বাজপাখির সমান! ছোটখাটো পাখির সমান হতো একেকটা মাকড়শা। সেকালে আমাদের চারপাশের পোকামাকড় হতো আক্ষরিক অর্থেই দৈত্যাকার।

এসব পোকামাকড়ের কথা শুনে অবশ্য ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ তখন মানুষের শক্তিও বাড়ত সেই অনুপাতে। কারণটা তো বুঝতেই পারছেন। আগের চেয়ে দ্বিগুণ অক্সিজেন ঢুকছে ফুসফুসে। ফলে মানুষের শারীরিক সক্ষমতা বেড়ে যাবে বহুগুণে। জীবনযাত্রার সবক্ষেত্রেই পড়বে এর প্রভাব। শক্তি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আরও বেশি সতর্ক হয়ে উঠত মানুষ। বেশি অক্সিজেন মানেই রক্তের প্রবাহ হতো আরও দ্রুত। ফলে শরীরে থাকত বাড়তি শক্তি ও সতর্কতা। সেই সঙ্গে আরও কিছু দারুণ ব্যাপার ঘটত। রোগবালাই কমে যেত মানুষের। রক্তে নিউট্রোফিল নামের বিশেষ ধরনের শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ বেড়ে যেত। ফলে ঠান্ডাজনিত রোগবালাই কম হতো।

মানুষের ওপর দ্বিগুণ অক্সিজেনের প্রভাব শুনে এতক্ষণ নিশ্চয়ই আপনার বেশ ভালো লেগেছে। লাগবে নাই-বা কেন! অতিমানবীয় শক্তি, প্রখর ইন্দ্রীয় আর রোগবালাই থেকে দূরে থাকতে চাওয়া মানুষের চিরকালের। সেটাই পাওয়া যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন দ্বিগুণ হলে। কিন্তু এর বিনিময়ে কী খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে? মানে, এসবের সাইড এফেক্ট কী?

বিশেষ করে, বড় আকারের জলাশয়ের পানি অক্সিডাইজেশন বা জারণের কারণে বিষাক্ত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডে রূপ নিতে পারে

বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদী জটিল অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অক্সিজেন দেহে অক্সিজেন টক্সিসিটি বা বিষাক্ততার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলবে। আংশিক চাপে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অক্সিজেন প্রশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিলে দেহে যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তার নাম অক্সিজেন বিষাক্ততা। পানির নিচে ডুবিরিরা বেশি অক্সিজেন টেনে ফেললে অনেক সময় এ বিষক্রিয়া দেখা যায় তাঁদের দেহে। ফলে সময়ের সঙ্গে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হবে, দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হয়ে যাবে ক্রমশ, এমনকি দেহের কোষের পুনরুৎপাদন বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

অতিরিক্ত অক্সিজেনের কারণে শরীরে তৈরি হতে পারে অক্সিজেনের ফ্রি র্যাডিকেল বা মুক্ত মূলক। এসব মূলকে দুটি ইলেকট্রন কম থাকে। এই পরমাণুগুলো খুব সক্রিয়। সবসময় অন্য পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আরেকটি পরমাণুর মুক্ত ইলেকট্রন জোড়ের সন্ধানে থাকে। দেহকোষ এবং কোষের ডিএনএ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এসব মুক্ত মূলকের কারণে।

অক্সিজেনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই গ্যাস আগুন জ্বালাতে দারুণভাবে সাহায্য করে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে জিনিসপত্রে আগুন ধরত আরও সহজে। এখনই মাঝে মাঝে দাবানলের তাণ্ডব দেখে আমরা আতংকিত হই। অক্সিজেন দ্বিগুণ হওয়ার পরে দাবানলের সংখ্যা ও তীব্রতা—দুটোই হবে ভয়াবহ। আগুন ধরা যেহেতু সহজ, তাই দাবানল ছড়িয়ে পড়বে পুরো পৃথিবীজুড়ে। শুধু দাবানল নয়, ছোট খাটো যেকোনো আগুনই এখনকার চেয়ে অনেক সহজে ছড়িয়ে পড়বে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়বে অতিভয়াবহ হারে। তা ছাড়া অতিদাহ্য এসব আগুন নেভানোও কষ্ট হবে এখনকার চেয়ে।

অক্সিজেন দ্বিগুণ হওয়ার পরে দাবানলের সংখ্যা ও তীব্রতা—দুটোই হবে ভয়াবহ
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

পৃথিবীতে অক্সিজেনে বেড়ে যাওয়া মানে পুরো পৃথিবীর ভর বেড়ে যাওয়া। অক্সিজেন কিন্তু শুধু বায়ুমণ্ডলের উপাদান নয়। পৃথিবীর উপরিভাগ, অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের গঠনেও আছে অক্সিজেনের বড় ভূমিকা। বেশি অক্সিজেন মানে ভূত্বকের ওজন বেড়ে যাওয়া। ভূত্বক বা লিথোস্ফিয়ারের ওজন হবে বায়ুমণ্ডলের চেয়ে বেশি। ফলে পরিবেশ অক্সিডাইজড বা জারিত হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে, বড় আকারের জলাশয়ের পানি অক্সিডাইজেশন বা জারণের কারণে বিষাক্ত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডে রূপ নিতে পারে।

বুঝতেই পারছেন, ঘটনাগুলো আসলে কী হচ্ছে। অন্য সবকিছুর মতো অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে ভালো-খারাপ দুটো দিকই দেখা যাবে। তবে আমাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি।

এ নিয়ে দুশ্চিন্তার আসলে কিছু নেই। পুরো দৃশ্যপটটাই কাল্পনিক। বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে শুধু সিমুলেট করা হয়েছে। বর্তমানে আমাদের বায়ুমণ্ডলে যে ২০ শতাংশ অক্সিজেন, তাতেই আমাদের দিন ভালো কাটছে। সবকিছু একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। এর বেশি অক্সিজেনের আসলে প্রয়োজন নেই আমাদের। প্রয়োজন শুধু এই পরিমাণটা ধরে রাখা। বিপুল পরিমাণ গাছ কাটা, পরিবেশ দূষণ, নগরায়ন, শিল্পকারখানা স্থাপন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ইত্যাদির কারণে গত কয়েক শ বছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে ফেলেছি আমরা। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য আমাদের অক্সিজেন বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। যতটুকু আছে, ততটুকু বিশুদ্ধ রাখতে পারলেই যথেষ্ট।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো, উইকিপিডিয়া