আপনার মন খারাপ নয় মোটেও। অথচ চোখ জ্বালা করছে, গড়িয়ে পড়ছে পানি। রহস্য আর কিছু নয়। পেঁয়াজ কাটতে গেলে অমন এক-আধটু হবেই।
আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় এই পেঁয়াজ অপরিহার্য। তরকারি রান্না করার জন্যে তো বটেই, ডালে পাঁচফোড়ন কিংবা মাছের দো-পেয়াজা, পেঁয়াজ ছাড়া যেন চলেই না। শুধু মশলা হিসেবে স্বাদের জন্য নয়, খাবার হিসেবেও পেঁয়াজ দারুণ উপকারী। এতে আছে ভিটামিন সি। এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ থেকে শুরু করে চোখের সমস্যা—এরকম বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে এ ভিটামিন। পাশাপাশি ত্বক ও চুলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়াও পেঁয়াজে আছে ভিটামিন বি। লোহিত রক্তকণিকা গঠনে সাহায্য করে। আছে পটাসিয়াম। রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে এটির ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সবই ঠিক আছে। কথা হলো, এত উপকারী পেঁয়াজ আমাদের কেন কাঁদায়? কেন পেঁয়াজ কাটার সময় চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে? এটা বুঝতে হলে প্রথমে জানা প্রয়োজন, চোখ থেকে অশ্রু ঝরে কেন?
আমাদের চোখের পাতার পেছনে আছে ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকেই নিঃসৃত হয় অশ্রু। এতে থাকে পানি, লিপিড, লাইসোজাইম (Lysozyme), লিপোক্যালিন, গ্লুকোজ এবং সোডিয়াম। এই অশ্রু, মানে প্রোটিন-সমৃদ্ধ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল তরল চোখের কোঠরের বাইরের প্রান্ত থেকে কর্নিয়ার দিকে যায়। প্রতিবার আমরা যখন চোখের পলক ফেলি, তখন এটি পুরো চোখের পৃষ্ঠকে ভিজিয়ে ফেলে। চোখকে কার্যক্ষম রাখতে এভাবে ভেজা রাখা জরুরি। তা ছাড়া নিয়মিতই ধুলোবালি আমাদের চোখে পড়ে। চোখের পানি এসব বর্জ্যকে ধুয়ে চোখ পরিষ্কার রাখে।
এবারে পেঁয়াজের বিষয়টা বলি। কাটার সময় পেঁয়াজ এক ধরনের যৌগ নিঃসরণ করে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া এই যৌগ জ্বালা সৃষ্টি করে চোখের অশ্রুগ্রন্থিগুলোতে। চোখের ওপরের মিউকাস পর্দাতেও খানিকটা অস্বস্তি হয় এর ফলে। এ ধরনের যেকোনো যৌগকে ইংরেজিতে বলে ‘ল্যাক্রিমেটর’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কান্না উদ্রেককারী’। আমাদের পরিচিত এরকম এক ধরনের ল্যাক্রিমেটরের নাম টিয়ার গ্যাস। যাই হোক, ল্যাক্রিমেটর অশ্রুগ্রন্থিগুলোতে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়ার ফলে চোখ পানি নিঃসরণ করে ধুয়ে দিতে চায়। ফলে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় কান্নার ইচ্ছে।
আর চোখের চারপাশে আছে ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি। এটি চোখে বিরক্ত সৃষ্টি করে। এই গ্রন্থিটি মেথিওনিন ও সিস্টিন দিয়ে গঠিত। এই দুটো রাসায়নিক আসলে অ্যামিনো এসিড পরিবারের অংশ। অ্যামিনো এসিড এক ধরনের জৈবযৌগ। এতে অ্যামিনো গ্রুপ (—NH2) থাকে। আমরা যখন পেঁয়াজ কাটি, তখন এর ভেতরের কোষগুলো ভেঙে যায়। সেখান থেকে যে গ্যাস বের হয়, তা সালফনিক এসিড তৈরি করে। পরে এই সালফনিক এসিড পেঁয়াজের কোষে থাকা ‘অ্যালিনেজ’ নামে এক ধরনের এনজাইমের সঙ্গে মিশে ‘প্রফেনথিয়াল-এস-অক্সাইড’ গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস আমাদের চোখে পৌঁছে চোখের পানির সঙ্গে মিশে যায়, তৈরি করে সালফিউরিক এসিড। এ সময় চোখের কর্নিয়া এই সালফিউরিক এসিডের উপস্থিতি শনাক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গে এটি ল্যাক্রিমাল গ্রন্থির ফ্লাডগেটগুলো খোলার জন্য সংকেত পাঠায় মস্তিষ্কে। এই সংকেত আমাদের চোখে জ্বালা সৃষ্টি করে।
পেঁয়াজ কাটার সময় চোখ জ্বালা করা থেকে বাঁচার কিছু উপায় আছে। যেমন পেঁয়াজ কাটতে ধারালো ছুরি ব্যাবহার করা। এর ফলে পেঁয়াজ দ্রুত কাটা যায়। ফলে সালফনিক এসিড আর খুব বেশি নিঃসৃত হয় না। আবার পেঁয়াজ কাটার সময় গাম চিবানো যায়, কিংবা নাকের বদলে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় মুখ দিয়ে। তা ছাড়া খোসা খুলে ফেলার আগে পেঁয়াজ পানিতে ভিজিয়ে রাখা যায়। কিংবা ১০-১৫ মিনিট রেখে দেওয়া যায় ফ্রিজে। এর ফলে কমে যায় পেঁয়াজ কাটার সময় নির্গত এসিডের পরিমাণ। আবার পেঁয়াজ কাটার সময় জিহ্বা বের করে রাখলে নিঃসৃত গ্যাসের কিছুটা জিহ্বায় শোষিত হয়। ফলে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায় চোখ জ্বালা করা থেকে।
এবারে একটা মজার তথ্য দিই। নিউজিল্যান্ডের কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশেষ এক ধরনের পেঁয়াজ তৈরি করেছেন। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এতে ল্যাক্রিমেটরি ফ্যাক্টর সংশ্লেষণ হয় না। এই সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন ল্যাক্রিমেটর এনজাইম। যে সব জিনের নির্দেশে এই এনজাইম পেঁয়াজে তৈরি হয়, জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘টিয়ার-ফ্রি’ পেঁয়াজ। মানে, যে পেঁয়াজ কাঁদায় না। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, স্থানীয় দোকান বা বাজারে এই পেঁয়াজ পৌঁছাতে আরও অন্তত ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: সায়েন্স ডিরেক্ট ও উইকিপিডিয়া