খোপা ঈগলের শিকার কাহিনি

এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…

খোপা ঈগলছবি: উইকিপিডিয়া

ছোট পুকুরটির পানি কমে গেল কার্তিক মাসে। বাড়ির লোকজন সব দলবেঁধে একদিন পুকুরে নামল মাছ ধরতে। খেপজাল ফেলার আগে সবাই মিলে পুকুরের শাপলাগাছ, পানিফলগাছসহ জলজ উদ্ভিদ ও শেওলা তুলে ফেলল। পুকুর হল তোলপাড়। জল ঘোলা। অঢেল মাছ ধরা পড়ল খেপজালে। শিশু-কিশোরেরা মাছ ধরল হাতিয়ে। ওদের হাতে আর খেপজালে ধরা পড়ল অনেকগুলো নির্বিষ জলসাপ। জলসাপের লেজ ধরে বোঁ বোঁ করে ঘুরিয়ে শূন্যে ছুড়ে দিল ওরা। শূন্য থেকেই ছোঁ মেরে ধরে নিল শঙ্খচিল আর একজোড়া ঈগল পাখি। ঈগলেরা ছিল শঙ্খচিলের চেয়ে বেশ বড়সড়, তাই ওরা শূন্যে ছুড়ে দেওয়া জলসাপ ডাইভ মেরে ধরছিল শঙ্খচিলের আগেই। শঙ্খচিলেরা যেগুলো ধরছিল সেগুলোও ওরা ধাওয়া করে ছিনতাই করছিল। ছিনতাই হলে শঙ্খচিলটি কান্নার মতো করে ডেকে উঠছিল। এমনিতেই ওদের ডাক কান্নার মতো শোনায়। ছোঁ মেরে ধরা, ডাইভ আর ছিনতাই দেখে কিশোরেরা তো বটেই, বড়রাও মজা পাচ্ছিল খুব। আসলে এ এক মজার খেলাই বটে। জলসাপ আজকাল কমে গেছে অনেক, কমে গেছে মজার এই খেলাটিও। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের পুকুর, বিল, ঝিল, জলাশয়ে প্রচুর জলসাপ ছিল। মাছ ধরতে গিয়ে সে সময় জলসাপ শূন্যে ছুড়ে বাজ-চিল, ঈগলদের ছোঁ মারা দেখেননি, এ রকম মানুষ বোধহয় কমই আছে। আমাদের পুকুরে জলসাপ আছে আজো (২০০৮)।

ছোট এই পুকুরটাতে ১৬টি শঙ্খচিল ও একজোড়া ঈগল এসে ভিড় জমিয়েছিল, মাছের চেয়ে বেশি লোভ ওদের জলসাপে। শঙ্খচিলগুলো সুযোগ পেলে ছোঁ মেরে ঘোলাজলের ওপর থেকে ছোটখাটো মাছও তুলে নিচ্ছিল, কিন্তু ঈগল দুটি উঁচু গাছে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল রাখছিল কখন জলসাপ শূন্যে ছোড়া হয়। জলসাপ শূন্যে উঠলেই ঈগল দুটি ধমক-ধামক মারতে মারতে জঙ্গিবিমানের মতো ডাইভ মারছিল। ভয়ে ধেয়ে আসা শঙ্খচিলেরা যাচ্ছিল ছিটকে। তবুও ভাগ্য ওদের ভালো বলতে হবে। ঈগল দুটি সাপ নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছিল মিনিট দশেকের জন্য, ফিরে আসছিল আবারো। এই সুযোগের মুহূর্তটুকু কাজে লাগিয়েছিল শঙ্খচিলেরা। ঈগলেরা খাবার নিয়ে যাচ্ছে ওদের বেশ বড়সড় মাচানের মতো বাসায়, যে বাসাটি পুকুর থেকে ৭০০ গজ দূরের এক ঘন বাগানে, মস্তবড় একটা আমগাছের মগডালে। বাসাটি বেঁধেছিল ওরা চুলচেরা হিসেব-নিকেশ করে। বাসার কেন্দ্রস্থলের ১০০ গজ পশ্চিম দিকে বেশ বড়সড় খোলা মাঠ। দক্ষিণে বিল। পূর্ব দিকেও মাঠ, উত্তরে বসতবাড়ি ও পুকুর। মানুষের বসতি ঘন নয়, বনবাগান বেশি, পুকুরও অনেকগুলো। বসতি এলাকা থেকে মাছ, জলসাপসহ হাঁস-মুরগির ছানা যেমন পাওয়া যাবে সহজে, তেমনি পশ্চিমের ধানের মাঠ থেকে পাওয়া যাবে ইঁদুর, বিষধর সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কুঁচেসহ ছোট ছোট পাখি। দক্ষিণের বিলে গেলে পাওয়া যাবে মাছ, চিলু সাপ, ঢোড়াসাপ, দাঁড়াশ সাপ, ব্যাঙ ও জলসাপ। পূর্বদিকের মাঠও দেবে খাদ্যের যোগান। বাসায় ছানা হলে যাতে খাবার সংগ্রহ করতে বেগ পেতে না হয়, সে হিসেব করেই দুজনে মিলে বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচন করেছিল ৬/৭ দিনে। তারপরে দুজনে মিলে শুকনো ডালপালা, পাটকাঠির অংশ, বাঁশের কঞ্চি ইত্যাদি এনে বাসাটি শেষ করেছিল ৮/৯ দিনে। দূর দূর থেকে উপকরণ ঠোঁট বা পায়ে চেপে ধরে ওরা উড়ে উড়ে এসেছিল আমগাছটাতে, যারা দেখেছিল তারা বুঝেছিল বাসা বাঁধছে ওরা। বেশ একগাদা ডালপালা নিয়ে উড়তে হিমশিম খাচ্ছে ওই ঈগলেরা, সে দৃশ্যটি কিন্তু কম মজাদার নয়।

দুটি বাচ্চা ইতোমধ্যে পেটে পুরেছে মোট ১৩টি জলসাপ, তবুও খাই খাই করছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খিদেও বাড়ে এদের। এই যে ঈগল, বাংলাদেশের এক চতুর শিকারি পাখি সে।

উপকরণ হয়তো খসে পড়ছে ঠোঁট বা নখর থেকে, সঙ্গে সঙ্গে সাঁই করে ডাইভ মেরে আবারো ধরছে শূন্যে, একটিকে ধরতে গিয়ে হয়তো আরেকটি উপকরণ যাচ্ছে পড়ে, এ রকম দৃশ্য দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। তো কাঠিকুঠি বা ডালপালা এনে সাজিয়ে বাসা বানানোও কম ঝক্কির কাজ নয়। দুজনকে তাই কষ্ট করতে হয়েছিল খুব। এমন গাছ আর এমন মগডাল তারা বাছাই করেছিল যে, যেখানে সহজে উঠতে পারবে না কোনো মানুষ। বাসা শেষ হলে মেয়ে পাখি ৪ দিন পরে প্রথম ডিমটি পেড়েছিল। পরদিন আরেকটি। তারপর ডিমে তা দিতে বসে গিয়েছিল। সারা রাত তো বটেই, দিনেরও অধিকাংশ সময় তা দিয়েছিল মেয়েটি। পুরুষটি অবশ্য নিজের পেটের খিদে মিটিয়ে বউয়ের জন্যও কিছু কিছু খাবার এনেছিল। একটু বিশ্রামের জন্য, ডানার আড়ষ্টতা কাটাবার জন্য বা পেটপুরে খাবার জন্য বউটি যখন বাসা ছেড়েছিল, তখন অবশ্য পুরুষটি ডিম দুটি একটু উল্টে পাল্টে দিয়েছিল। বসেছিল ডিম পেটের তলায় নিয়ে। ডিমের সাইজ আমাদের দেশি মুরগির চেয়ে চারগুণ বড়। গোল ধরনের। চকচকে ডিমের রঙ সাদাটে হলুদ। তার ওপরে লালচে বাদামি ও কালচে ছিটছোপ। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছিল ২৯ দিন বাদে। সেই বাচ্চাদের বয়স আজ ১০ দিন। উড়তে পারবে আরো ২৫/৩০ দিন পরে। পেট আর চোখ ভরা খিদে ওদের। ওদের পেট ভরাতে গিয়ে বাবা-মা হিমশিম খেয়ে যায়। হাঁস-মুরগির ছানা কী আর অত সহজে ধরা যায়। মানুষও তেড়ে আসে। শুধু মাছ আর ব্যাঙ খেয়েও বাচ্চাদের তৃপ্তি হয় না।

খোপা ঈগল
অলংকরণ: হাশেম খান (২০০৮)

এই শিকারি পাখিটির নাম তিলাঈগল, তিলাবাজ বা ছিটবাজ অথবা খোপা ঈগল বা খোপাবাজ। ঈগল ও বাজের ভেতর পার্থক্য আছে। ইংরেজি নাম Crested Serpent Eagle. বৈজ্ঞানিক নাম Spilornis cheela। মাপ ৭২- ৭৪ সেন্টিমিটার।

ওদের চাই মাংস। ডাইভ মেরে চড়ুই, ভরত, ঘুঘুর বাচ্চা অবশ্য শিকার করেছে মা-বাবা, তাতেও তৃপ্তি হয়নি বাচ্চাদের। সারাদিন শুধু খাই খাই করে। বাসায় বসে দুটিতে মারামারি করে। রক্তারক্তি কাণ্ড পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলে। ঠিক সে রকম সময়েই ছোট পুকুরটাতে জাল পড়েছে, বেশ জলসাপও পাওয়া যাচ্ছে, ঈগল দুটি তাই মহাখুশি। সব ধরনের সাপই হচ্ছে এদের সবচেয়ে প্রিয় এবং প্রধান খাদ্য। তাই তো পাগলের মতো ছুড়ে দেওয়া জলসাপ ধরছে ওরা, বাসায় গিয়ে ঠোঁটে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছে বাচ্চা দুটিকে, ফিরে আসছে আবারো। দুটি বাচ্চা ইতোমধ্যে পেটে পুরেছে মোট ১৩টি জলসাপ, তবুও খাই খাই করছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খিদেও বাড়ে এদের। এই যে ঈগল, বাংলাদেশের এক চতুর শিকারি পাখি সে। ঘাপটি মেরে বসে থাকে গাছপালায়। মাঠের ভেতরের বা রাস্তার পাশের বিদ্যুতের পোলে বা তারে, লক্ষ্য রাখে পুকুর, জলাশয়, বনবাগানের তলায় বা মাঠে-ঘাটে। শিকার দেখলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে না সঙ্গে সঙ্গে। মাথাটা ঘন ঘন ওপর-নিচ করে, পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। সে সময় ওর মাথার পেছনের সুন্দর খোপামতন পালকগুলো জেগে ওঠে, ওই খোপাটিও ছোট-বড় হয়, মাথা ওঠা-নামার সাথে তাল-লয় ঠিক রেখে। যখন সে ডাইভ মারে বা ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর, তখন কিন্তু খোপাটি একেবারে মিলিয়ে যায়। তবে শিকার যদি হয় বিষধর সাপ বা বেজির ছোট বাচ্চা অথবা বনবিড়ালের ছোট বাচ্চা, তখন খোপাটি একেবারে ‘আকাশি খোপা’ হয়ে যায়। উত্তেজিত হলেই ওই খোপাটি জাগে, উত্তেজনা কমে গেলে খোপা মিলিয়ে যায়। বিষধর সাপ ধরার সময় এরা সুকৌশলে ধরে, এক পা দিয়ে ধরে সাপের ঘাড়, অন্য পা দিয়ে কোমর বা কোমরের নিচে। যাতে ছোবল দিতে না পারে, না পারে পা বা শরীর পেঁচিয়ে ধরতে। বিষধর সাপও তো কম শক্তিশালী প্রাণী নয়। সাপ ধরার ক্ষেত্রে তাই প্রচুর পরিশ্রম ও যুদ্ধ করতে হয়। ও সময় মাটিতে থেকে দুডানা রাখে মেলে, ঠোঁট চালায়। দুই পাখাকে হাতের মতো ব্যবহার করে সাপকে পিটায়।

বাচ্চা ধরার সময় ওরা খেয়াল করে না যে, আশেপাশেই থাকতে পারে ওদের বাবা-মা। বাচ্চাদের চেপে ধরে মাটিতে, ঠোঁট চালায়। বনবিড়ালের বাচ্চাকে কবজায় রাখতে গিয়েই ওরা বিপদে পড়ে যায়।

সব ধরনের ‘সাপ-শিকারি’ পাখিই সাপ শিকারের সময় সাপের ঘাড় ও কোমর একসঙ্গে নখরে চেপে ধরে। না হলে মহাবিপদ ঘটে যেতে পারে। সাপের ঘাড় ফসকে গেলে সাপ প্রবল আক্রোশে ছোবল মারে। কিন্তু অন্যান্য সাপ-শিকারি পাখিদের মতো এই শিকারি পাখিটিও একই সঙ্গে পাখা ও পা বাড়িয়ে দিয়ে ছোবল অকেজো করে দিতে মহা ওস্তাদ। তার পরেও ছোবল দিলে প্রায় ক্ষেত্রেই সাপের বিষদাঁত লোমশ পায়ের পালক ভেদ করে চামড়ায় পৌছুতে পারে না। আমি দুই বার দুটি আনাড়ি পাখিকে সাপের ছোবলে মরতে দেখেছি, কৌশল পুরোপুরি আয়ত্তে আনার আগেই ওরা বিষধর গোখরো সাপ শিকার করতে চেয়েছিল। একটি মরেছিল চোখে ছোবল খেয়ে, অন্যটি ছোবল খেয়েছিল গলার ঠিক নিচটায়। বনবিড়ালের বাচ্চা ধরার পরে ৫ বার আমি বনবিড়লের হাতে মরতে দেখেছি এই ঈগলটিকে, একবার দেখেছি একজোড়া বেজির হাতে মরতে।

বেজির বাচ্চা ধরেছিল সেবার। বাচ্চা ধরার সময় ওরা খেয়াল করে না যে, আশেপাশেই থাকতে পারে ওদের বাবা-মা। বাচ্চাদের চেপে ধরে মাটিতে, ঠোঁট চালায়। ডানা দুটি মেলে ঝটপট শব্দ তুলে পলাতক বেজি বা বনবিড়ালের বাচ্চাকে কবজায় রাখতে গিয়েই ওরা বিপদে পড়ে যায়। বাংলাদেশের অন্যান্য শিকারি পাখিদের চেয়ে এরা কম দ্রুত গতি সম্পন্ন, ডাইভও খুব ভালো মারতে পারে না। শঙ্খচিলেরাও এদের চেয়ে ভালো ডাইভার। ধাওয়া করে শিকার ধরতেও পটু নয় এরা। তবে শীতকালে সাপ ধরতে এরা অন্যান্য শিকারি পাখির চেয়ে বেশি দক্ষ বলেই আমার মনে হয়েছে। শীতকালে বিষধর সাপেরা গর্ত থেকে আধখানা বা পুরো শরীর বাইরে এনে রোদ পোহায়। এই ঈগলেরা তক্কে তক্কে থাকে। রোদ-পোহানো সাপকে ধরে ফেলে। এখানে উল্লেখ্য যে, এদের বাসায় বাচ্চা হয় শীতের শুরুতে, শীতে অথবা শীত ফুরোবার সময়। বাচ্চাদের তো বটেই, নিজদেরও প্রিয় খাবার সাপ। তাই সাপ শিকারের মওকা খোঁজে এরা।

খোপা ঈগলের প্রিয় খাবার হচ্ছে সাপ
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমি কমপক্ষে ৩৩ বার এদের বাসা দেখেছি। ১৬টি বাসায় ১টি, ৩টি বাসায় দুটি করে ডিম দেখেছি। ১৪টি বাসার কাছে আমি চড়তে পারিনি, চড়া সম্ভব ছিল না। ওদের ১টি ডিম সরিয়ে মুরগির ডিম দিয়েছি। ওদের ডিম দিয়েছি মুরগির পেটের তলায়। মুরগি না বুঝে তা দিয়েছে। ডিম ফোটেনি। আর, ওই পাখিটি বাসায় ফিরে বুঝে ফেলেছে সব। খেয়ে ফেলেছে মুরগির ডিম। দুই তিন বার আমি এ রকম ‘ডিম বদলের খেলা’ খেলে জিততে পারি নি।

চমৎকার খোপাওয়ালা এই শিকারি পাখিটির নাম তিলাঈগল, তিলাবাজ বা ছিটবাজ অথবা খোপা ঈগল বা খোপাবাজ। ঈগল ও বাজের ভেতর পার্থক্য আছে। আমার বিচারে এই পাখিটি ঈগল। তাই আমি বলি তিলাঈগল বা খোপাঈগল। ইংরেজি নাম Crested Serpent Eagle। বৈজ্ঞানিক নাম Spilornis cheela। মাপ ৭২-৭৪ সেন্টিমিটার।

খোপা ঈগলের মেয়ে পাখিটি পুরুষের চেয়ে সামান্য বড় হয়। ওর মাপ ৭৬-৭৭ সেন্টিমিটার। পুরুষটি বেশি ডাকাডাকি করে।

খোপাটি পুরোপুরি জাগলে হয় ৪ সেন্টিমিটার। জীবন্ত অবস্থায় মাপা সম্ভব নয়। মরা পাখি পেলে ওই খোপার পালক সঠিকভাবে জাগিয়ে মাপা যেতে পারে। আমাদের দেশে শীতে আজকাল ক্বচিৎ দেখা যায় আরেক রকম ঈগল, (শিখর যুক্ত ঈগল Imperial Eagle), যাদের মাথায়ও আছে খোপা বা শিংয়ের মতো পালক।

খোপা ঈগলের খোপাটি যেমন চমৎকার, তেমনি চমৎকার ওদের ডানা ও লেজের তলাটা। উড়ন্ত অবস্থায় নিচ থেকে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যাবে না। উড়ন্ত অবস্থায় লেজের প্রান্তদেশে চওড়া কালো দাগ, তার ওপর দিকে চওড়া সাদা দাগ, তারও ওপরে আবার চওড়া কালো দাগ। সবগুলো দাগই মেলানো লেজের একপাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত। ডানার অবস্থা লেজের মতোই, তবে ওপরিভাগের আড়াআড়ি কালো দাগটা কম চওড়া। ওই কালো দাগের ওপরে আবার আরও কম চওড়া সাদা দাগ আছে। পাখার ওপরিভাগ (পাখার তলদেশের ওপরিভাগ) সাদা সাদা ছিটে ভরা। হালকা লালচে-বাদামি বুক পেটেও একই রকম সাদা সাদা ছিটে ভরা। ছিট আর সাদা-কালোর চওড়া টানের অপূর্ব ও চমৎকার সমন্বয় ওড়ার সময় নিচ থেকে দেখা যায়। বসা অবস্থায় পাখিটির পিঠ ও পাখার উপরিভাগ বাদামি। দুই-চারটে সাদা ছিটছোপ। লেজের ওপরিভাগের প্রান্তদেশ বাদামি। তার ওপরে আড়াআড়ি চওড়া সাদা টান, লেজের তলাটাও তাই। বুক-পেটের সাদা ছিটছোপ পরিষ্কার দেখা যায়। ডানার প্রান্তটা কালো। ঠোঁটের রঙ নীলচে-বাদামি। গোসল করলে বা বৃষ্টিতে ভিজলে এদেরকে কালচে পাখি বলে মনে হয়। বৃষ্টিতে ভিজলে বা গোসল শেষে এরা যখন রোদে পাখা মেলে ধরে তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে।

খোপা ঈগলের মেয়ে পাখিটি পুরুষের চেয়ে সামান্য বড় হয়। ওর মাপ ৭৬-৭৭ সেন্টিমিটার। পুরুষটি বেশি ডাকাডাকি করে। বাসা বাঁধার সময়, বাসায় ডিম-বাচ্চা হবার পরে খুশিতে এরা উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে বা বসে ডাকাডাকি করে। ডাকের স্বর হচ্ছে ‘কী কী কিক্‌রী-কী কী...’। বেশ তীক্ষ্ণ ও সুরেলা ওই ডাক। ওই ডাক শুনলে পাখির ও হাঁস-মুরগির ছানাদের বুক কাঁপে। যে কোনো পাখি ও হাঁস-মুরগিদের টেনশন বাড়ে।

খোপা ঈগল বাংলাদেশে আজো বেশ আছে। হাঁস-মুরগির ছানার দিকে এরা না পারতে হাত বাড়ায় না, তবুও ওই অপরাধে গুলি খেয়ে মরে, মানুষ ওর বাসা তছনছ করে। অকারণে এয়ারগান দিয়ে মারে। কিন্তু এটা একেবারেই উচিৎ নয়। দুই একটা হাঁস-মুরগির ছানা বা পুকুরের মাছ খেয়ে ওরা যেটুকু ক্ষতি করে, তার চেয়ে হাজার গুণ উপকার করে বিষধর সাপ ও ধানক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এরা অপরিসীম ভূমিকা পালন করে থাকে। উপকারী এই শিকারি পাখিটিকে তাই ভালো অবস্থায় রাখতেই হবে। ভালো রাখতে হবে সব ধরনের শিকারি পাখিকে।

লেখক: প্রকৃতিবিদ ও পাখিবিশারদ

* লেখকের বাংলাদেশের পাখি (৩য় খণ্ড), শিশু একাডেমি (২০০৮) থেকে নেওয়া