জীববিজ্ঞান
প্রজাপতির বর্ণিল জীবন
প্রজাপতির জীবন বেশ রহস্যময় ও বর্ণিল। এই বর্ণিল জীবনে বেশ কিছু বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় প্রাণীটি। চারটি পর্যায়ে বড় হয় ধীরে ধীরে। শূককীট থেকে পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ রঙিন প্রজাপতিতে। সেই প্রক্রিয়ার সবিস্তার বিবরণ...
মার্কিন লেখক এরিক কার্ল। ১৯৬৯ সালে তিনি শিশুদের জন্য দ্য ভেরি হাংরি ক্যাটারপিলার নামে একটি বই লেখেন। একটি প্রজাপতির বাচ্চা বা ক্যাটারপিলারের গল্প। নিজের রাক্ষুসে খিদে মেটাতে কত রকমের খাবার গোগ্রাসে খেয়েছিল, তার বর্ণনা। বইটি অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশ্বের প্রায় ৬০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, ছাপা হয়েছিল পাঁচ কোটির বেশি কপি। বইটিতে একটি প্রজাপতির বাচ্চা সপ্তাহের সাত দিনে কী কী খেয়েছিল, খাওয়ার পর তার কী হয়েছিল, তার একটা চমত্কার বর্ণনা রয়েছে।
বইটির সারাংশ এ রকম—রোববার সকালে প্রজাপতির ডিম ফুটে একটা ছোট্ট বাচ্চা বের হলো। ডিম থেকে বের হওয়ার পরই খুব খিদে পেল তার। কী খাওয়া যায়? সে আশপাশে খাবার খুঁজতে শুরু করল। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত পাঁচ দিন শুধু খেয়েই চলল সে। রোজই বাড়াতে লাগল খাবারের পরিমাণ। সোমবার খেল একটা আপেল, মঙ্গলবারে দুটি নাশপাতি, বুধবার খেল তিনটি প্লাম, বৃহস্পতিবার চারটি স্ট্রবেরি এবং শুক্রবার খেল পাঁচটা কমলালেবু। এত কিছু খাওয়ার পরও তার খিদে যেন মিটছেই না। তাই শনিবারে সে এক টুকরা চকলেট কেক, চেরি পাই, সসেজ, একটি কাপকেক ও একখণ্ড তরমুজ দিয়ে ভোজ সারল। সেই রাতে বেশি খাওয়ার জন্য তার পেটে ব্যথা শুরু হলো। সে জন্য পরদিন রোববার সে আর এসব কিছুই খেল না, খেল শুধু একটা গাছের সবুজ পাতা। খাওয়ার পর তার বেশ ভালো বোধ হলো। এখন আর আগের মতো এত খিদে লাগছে না, পেটে ব্যথাও নেই। আগের চেয়ে এখন সে বেশ বড় হয়েছে, আর মোটাও। তার এখন বিশ্রাম দরকার। তাই সে দেহের চারপাশে একটা খোলস তৈরি করে তার ভেতরে দুই সপ্তাহের জন্য ঘুমাতে গেল। দুই সপ্তাহ পর তার ঘুম ভাঙল। সে আর সেই বাচ্চাটি নেই। এখন তার সুন্দর পাখা হয়েছে, সে একটা প্রজাপতি হয়ে গেছে। খোলসের এক পাশে একটা ফুটো করে বাইরে বেরিয়ে এল সে। অন্ধকার খোলস থেকে বাইরের আলোয় বেরিয়ে সে রঙিন প্রজাপতি হয়ে উড়তে লাগল ফুল থেকে ফুলে ফুলে।
বাচ্চাদের দেহের ভেতরে সেই বোলতার ডিম ফুটে ওদের বাচ্চা বের হয় ও দেহের ভেতরে নাড়িভুঁড়ি-মাংস সব খেতে থাকে। এতে মলিন হয়ে যায় প্রজাপতির বাচ্চাগুলো, নিস্তেজ হয়ে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে পড়ে থাকে।
প্রজাপতির জীবনটা এমনই। এত সহজ-সুন্দর করে আর কোনো বইয়ে আপনারা ওদের জীবনকথা জানতে পারবেন না। প্রজাপতিরা কিন্তু ওদের বাচ্চাদের মতো পাতা খায় না। ওরা ফুল থেকে ফুলে ঘুরে ঘুরে ফুলের মধু খায়। ফুল থেকে ফুলে বেড়ানোর সময় ওদের পায়ের ঘষায় ফুলের রেণুগুলো মাখামাখি হয়ে যায়। আর তাতেই গঠন শুরু হয় ফল ও বীজের। কী উপকারই না করে ওসব গাছের! না হলে গাছেদেরও তো বংশ রক্ষা হতো না। আর আমরাও কোনো ফল বা বীজ খেতে পেতাম না। প্রজাপতি তাই আমাদের বন্ধু। কিন্তু ওদের বাচ্চাগুলো নচ্ছার, আপদ, শত্রু। ওরা গাছের পাতা খায়, ফল খায়, ফুল খায়। এসব খেয়েদেয়ে বড় হয়। আর তাতে কৃষকদের খুব ক্ষতি হয়, গাছেরও। প্রকৃতিমাতা তা জানেন। আর সে জন্য ওসব বদমাশ বাচ্চাদের শাসন করতে তিনি আরেক দল পোকাকে পাঠিয়ে দেন। ওরা যেন পুলিশ!
বাচ্চাগুলো পাতা খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। খাওয়ার সময় তো প্রজাপতির বাচ্চাগুলোর আর কোনো দিকে খেয়াল থাকে না। তাই ওরা বুঝতে পারে না পুলিশ পোকারা তাদের শায়েস্তা করতে এসেছে। ছোট ছোট বোলতা হলো পুলিশ পোকা। ওরা এসে কী করে? ওরা এসে প্রজাপতির বাচ্চাদের গায়ে হুল ফুটিয়ে দেয়। হুলের নল দিয়ে ওদের গায়ের মধ্যে ডিম পেড়ে দেয়। যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে বাচ্চাগুলো। কিন্তু পুলিশকে ধরবে কে? ডিম পেড়েই ওরা পগার পার। বাচ্চাদের দেহের ভেতরে সেই বোলতার ডিম ফুটে ওদের বাচ্চা বের হয় ও দেহের ভেতরে নাড়িভুঁড়ি-মাংস সব খেতে থাকে। এতে মলিন হয়ে যায় প্রজাপতির বাচ্চাগুলো, নিস্তেজ হয়ে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে পড়ে থাকে। একসময় মরে যায়। আর ওদের দেহের ভেতর থেকে বোলতার বাচ্চাগুলো বেরিয়ে আসে, নতুন করে অন্য প্রজাপতির বাচ্চাদের খুঁজতে থাকে। এমনকি প্রজাপতির বাচ্চাগুলো খোলসের মধ্যে ঘুমাতে গেলেও বোলতারা তা টের পায়। তখন ওরা সেখানেও হুল ফুটিয়ে খোলসের ভেতরে ডিম পেড়ে দেয়। তখন আর সেসব প্রজাপতির বাচ্চার প্রজাপতি হয়ে ওঠা হয় না, ওরাও মরে যায়।
প্রজাপতির জীবনটা আসলে বেশ রহস্যময়। কত হাজার রকমের প্রজাপতি যে আমরা দেখি! বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পৃথিবীতে প্রজাপতির আবির্ভাব হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে। প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ বছর পুরোনো একটি প্রজাপতির জীবাশ্ম তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন ডেনমার্কে। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫০০ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। আপনার চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখুন, সব প্রজাপতি কি দেখতে এক রকম? হুবহু এক রকমগুলোকে বলা হয় একটি প্রজাতি। একেক রকমের প্রজাপতির রং, রূপ ও আচরণ আলাদা। ওদের বাচ্চাদের চেহারাও আলাদা।
প্রজাতিভেদে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত মিলনরত অবস্থায় থাকতে পারে। ছেলে প্রজাপতির পুচ্ছদেশে একধরনের আলোকসংবেদী কোষ থাকে, যার সাহায্যে ওরা খুঁজে নেয় মেয়ে প্রজাপতির জননাঙ্গকে।
প্রজাতিভেদে প্রজাপতিরা বাঁচে এক সপ্তাহ থেকে এক বছর। প্রজাপতি চেনার ভালো উপায় হলো ওদের পাখা দেখা। প্রজাপতির মতো আরেক রকমের পোকা আছে, ওদের বলে মথ। প্রজাপতির ডানা বড় ও ছড়ানো। ওরা যখন কোথাও বসে, তখন পাখাগুলো আকাশের দিকে ভাঁজ করে রাখে। আর মথ কোথাও বসলে ওদের পাখাগুলো মাটির সমান্তরালে ভাঁজ করে রাখে। লেবুর প্রজাপতি আর ধানের মাজরা পোকার মথ দেখলে এই পার্থক্য সহজে বোঝা যায়। প্রজাপতিরও ছেলে আর মেয়ে আছে। একই প্রজাপতির ছেলেগুলো মেয়েদের চেয়ে আকারে ছোট হয়। ছেলে প্রজাপতি ও মেয়ে প্রজাপতির মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্ব করার জন্য ওরা যখন বাতাসে উড়তে থাকে, তখন একজন আরেকজনকে পছন্দ করে। যে বন্ধুত্ব করতে চায়, সে তখন নিজের গা থেকে একধরনের সুগন্ধি রাসায়নিক দ্রব্য গ্যাসের মতো করে বাতাসে ছেড়ে দেয়। এই দ্রব্যকে বলে ফেরোমন। অপরজন যদি বন্ধুত্বে আগ্রহী হয়, এ গন্ধ পেলেই সে সাড়া দেয়। দুজনে তখন মাটিতে নেমে আসে ও ডালপালা বা কাঠির ওপর থিতু হয়ে বসে মিলিত হয়।
একে–অপরের দিকে পেছনের অংশ ছুঁইয়ে মিলিত হয় তারা। প্রজাতিভেদে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত মিলনরত অবস্থায় থাকতে পারে। ছেলে প্রজাপতির পুচ্ছদেশে একধরনের আলোকসংবেদী কোষ থাকে, যার সাহায্যে ওরা খুঁজে নেয় মেয়ে প্রজাপতির জননাঙ্গকে। এরপর সেখানে ছেলে প্রজাপতি শুক্রাণু ছেড়ে দেয়। কোনো ছেলে প্রজাপতি যাতে আবার ওই মেয়ে প্রজাপতির সঙ্গে মিলিত হতে না পারে, সে জন্য কোনো কোনো ছেলে প্রজাপতি একধরনের রাসায়নিক পদার্থ ছেড়ে মেয়ে প্রজাপতির জননাঙ্গের মুখ বন্ধ করে দেয়। অথবা সেখানে এমন একধরনের সুগন্ধ মাখিয়ে দেয়, যেগুলো শুঁকে অন্য ছেলে প্রজাপতিরা বুঝতে পারে যে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। তাই ওরা তাকে এড়িয়ে চলে, মেয়েরাও আর মিলনে যায় না।
কোনো কোনো প্রজাতি আবার মিলন ছাড়াই বাচ্চা প্রসব করে, ওদের ডিম হয় না। ইয়েলো ক্লাউডেড বা সালফার বাটারফ্লাইগুলো এভাবে তাদের বাচ্চা জন্ম দেয়। ভীষণ মজার এই পোকাদের বন্ধুত্বের কাহিনিগুলো।
সাধারণত একটা প্রজাপতি ১০০ থেকে ২০০টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো একধরনের আঠা দিয়ে পাতার সঙ্গে আটকে রাখে ওরা, যাতে সেগুলো মাটিতে পড়ে না যায়। ডিম আটকানোর জন্য ওরা যে আঠা তৈরি করে, সেগুলোর রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল, একেক প্রজাপতির একেক রকম।
এরপরই শুরু হয় তার বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া। প্রজাপতির জীবন সম্পন্ন হয় চারটি ধাপে। মিলনের পর মেয়েদের ডিমের থলিতে ডিম হয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়, যাকে বলা হয় শূককীট। বাচ্চারা কয়েকবার (সাধারণত ৫-৬ বার) খোলস বদলানোর পর পুতুলের মতো খোলস তৈরি করে তার মধ্যে পুত্তলি অবস্থায় থাকে, যাকে বলে মূককীট। কিছুদিন ওই খোলসের ভেতরে থাকার পর খোলস কেটে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। এগুলোকে বলে পূর্ণাঙ্গ পোকা। প্রজাপতির জীবন এই চারটি ধাপে সম্পন্ন হয় বলে ওদের জীবনকে বলা হয় সম্পূর্ণ রূপান্তর।
একটি প্রজাতি অনেক ডিম পাড়ে। ডিমের কুসুম কিছুটা শক্ত খোসার মধ্যে থাকে, যাকে বলে কোরিয়ন। ডিম যাতে রোদে–বাতাসে শুকিয়ে না যায়, সে জন্য মেয়ে প্রজাপতি একধরনের মোমের চাদর দিয়ে ডিমগুলোকে ঢেকে ফেলে। কোনো কোনো প্রজাপতি পাতার ওপরে বা নিচে, ডালে একটা একটা করে ডিম পাড়ে। আবার কেউ কেউ ডিম পাড়ে গাদা করে। সাধারণত একটা প্রজাপতি ১০০ থেকে ২০০টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো একধরনের আঠা দিয়ে পাতার সঙ্গে আটকে রাখে ওরা, যাতে সেগুলো মাটিতে পড়ে না যায়। ডিম আটকানোর জন্য ওরা যে আঠা তৈরি করে, সেগুলোর রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল, একেক প্রজাপতির একেক রকম। তবে সব ঘন আঠাই বাতাসে এসে শক্ত হয়ে যায়, পানিতে গলে না। এ জন্য বৃষ্টিতেও ডিমগুলো সেখানে আটকে থাকে। তবে কখনো কখনো এ ডিমগুলো আবার কোনো কোনো বোলতা দ্বারা আক্রান্ত হয়। বোলতারা পরজীবিতা দিয়ে ডিমগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। মানে, প্রজাপতির ডিমের মধ্যে ডিম পেড়ে দেয়। এ যেন কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো ঘটনা। প্রজাপতির ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর আগেই সেসব বোলতার বাচ্চারা বেরিয়ে ডিমের ভেতরে খেতে খেতে বড় হয়। প্রজাপতির সেসব ডিম থেকে আর বাচ্চা ফোটে না। বেশির ভাগ প্রজাপতির ডিম ফুটতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লেগে যায়।
একেক স্তরে খোলস বদলানোর পর রং বদলে যায়। প্রতিবার খোলস বদলানোর পর ওরা সে দশায় কয়েক দিন থাকে। শেষ অবস্থায় একধরনের নিউরোহরমোন ছেড়ে আবার খোলস বদলানোর প্রক্রিয়ায় যায়।
কোনো কোনো প্রজাপতির বাচ্চাদের দেখলে ভয় লাগে। সারা গা কেমন বিশ্রী, শুঁয়ায় ভরা! আবার কারও কারও গা নরম থলথলে মসৃণ, কারও কারও মাথায় থাকে একটা শিং, কারও আবার দুটি। এই শিং বা শুঙ্গের দ্বারা ওরা ঘ্রাণ নেয়; কী খাবে, কী খাবে না, তা বুঝতে পারে। আবার লেজের দিকেও লম্বা সুতার মতো কারও কারও কিছুটা বাড়ানো থাকে, চোখও থাকে মাথায়। তবে আমাদের মতো ওদের মাথায় বা মুখে কোনো নাক থাকে না। তাহলে শ্বাসপ্রশ্বাস চলে কী করে? ওদের দেহের দুই ধারে কিছু শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র থাকে, কতগুলো ছিদ্রের মতো। এগুলোকে বলে ট্রাকিয়া। এর মাধ্যমেই ওরা শ্বাস নেয়। প্রতিটি বাচ্চার বুকের দিকে ছয়টি পায়ের মতো অঙ্গ থাকে, যার ওপর ভর করে ওরা হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে চলে। আর রং? তার কোনো শেষ নেই। মজার ব্যাপার হলো, ওদের রংটা নির্ভর করে কী খাচ্ছে তার ওপর; আর বড় হয়ে প্রজাপতির রংটা কেমন হবে, তার ওপর। যেমন মনার্ক প্রজাপতির বাচ্চার রঙের সঙ্গে প্রজাপতির পাখার হলদে-কমলা ও ঘিয়া রঙের অনেকটা মিল আছে। আবার ওদের এই শূককীট দশা কয়েকবার খোলস বদলানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয়। একেক স্তরে খোলস বদলানোর পর রং বদলে যায়। প্রতিবার খোলস বদলানোর পর ওরা সে দশায় কয়েক দিন থাকে। শেষ অবস্থায় একধরনের নিউরোহরমোন ছেড়ে আবার খোলস বদলানোর প্রক্রিয়ায় যায়। এই খোলস হলো ওদের ত্বক, যা একধরনের বিশেষ প্রোটিন ও কাইটিন দিয়ে তৈরি। খোলস বদলানোটা অনেকটা আমাদের পোশাক বদলানোর মতো। পুরোনো জামা খুলে নতুন জামা পরার মতো। খোলসটা পুরোনো হলে আর দেহ বড় হতে থাকলে, খোলসটা আর আগের সেই দেহকে ধরে রাখতে পারে না। তখন খোলসটা ফেটে যায়। দেহের ওপর আবার নতুন একটা খোলস তৈরি ও প্রসারিত হয়। এ সময় দেহে রং সৃষ্টিকারী কিছু রঞ্জকদানা বা পিগমেন্টও তৈরি হয়। এর কারণেই শেষবার খোলস বদলানো শেষে প্রজাপতির পাখার গঠন ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরু করে। তখন বাচ্চাগুলো দ্রুত ঘুমাতে যায়।
ওরা ঘুমায় অনেকটা আমাদের হোল্ডলের মতো একটা বিছানায়, একটা খোলসের মতো গড়নের ভেতর। দেখতে সেগুলো অনেকটা পুতুলের মতো দেখায় বলে ওগুলোকে বলে পুত্তলি। পুত্তলি কোনো পাতা বা ডালের সঙ্গে শক্ত করে আটকে রাখে। অনেকটা বাবুই পাখির বাসার মতো সেগুলো বাতাসে দুলতে থাকে, কিন্তু কখনো খুলে পড়ে যায় না। প্রজাপতির বাচ্চারা যখন বড় হয়ে যায়, তখন তারা কিছু হরমোন তৈরি করে; যেমন প্রোথোরাসিকোট্রপিক হরমোন। ওই সময় তারা কোথায় ওদের পুত্তলিকে আটকানো যায়, সে জায়গাও খুঁজতে থাকে। সেটা পেলে খুব দ্রুত বাচ্চারা তাদের দেহের চারপাশে একধরনের রেশমি সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে খোলস তৈরি করে ফেলে। এই খোলস ওদের ঝড়ঝাপটা ও শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে। আবার সবাই যে এ রকম করে, তা নয়। কিছু কিছু প্রজাপতির বাচ্চা আবার ফাঁসির দড়িতে ঝোলার মতো করে ঝুলতে থাকে। মাথাটা থাকে নিচের দিকে ঝোলানো, কোনো খোলস থাকে না। ওভাবেই ঘুমাতে থাকে। এ দশায় বাচ্চাদের দেহের সবকিছু ভেঙে সত্যিকার একটা প্রজাপতি হয়ে ওঠার জন্য নতুনভাবে গড়ে ওঠা শুরু হয়। পাখাগুলো ভেতরে থাকে লম্বালম্বিভাবে ভাঁজ করা অবস্থায়। এর মাঝে গঠিত হয় শুঁড়, শুঙ্গ বা অ্যানটেনা ও পা। কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ এভাবে থাকার পর সেসব খোলস ফেটে বা কেটে বেরিয়ে আসে রঙিন প্রজাপতি। বেরিয়েই কিন্তু ওরা সঙ্গে সঙ্গে উড়তে পারে না। পাখাগুলো শুকিয়ে যেতেই ওরা ডানা মেলতে শুরু করে আর খাবারের সন্ধানে ছুটে চলে ফুল থেকে ফুলে। যখন ফুল থাকে না, তখন ওরা পাতায় পড়া শিশির খেয়ে বাঁচে। না পেলে খায় পরাগরেণু, ফলের রস বা পানি। আমরা স্ট্র দিয়ে যেমন কোল্ড ড্রিংকস বা জুস খাই, ওরাও ওদের একটা শুঁড় দিয়ে সেভাবে খাবার চুষে খায়। পেট ভরলে, সাবালক হলে আবার ওরা বন্ধুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। পৃথিবীতে নিজের সন্তান রেখে যাওয়ার জন্য আবার ওদের সেই একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।