বাংলাদেশের নতুন প্রজাপতিরা

পৃথিবীর বুকে বৈচিত্র্যময় প্রাণীদের সমাহার আমাদের নীল গ্রহটির সৌন্দর্যের মোহনীয়তা বাড়িয়েছে বহু গুণ। এসব প্রাণীদের মধ্যে প্রজাপতিরা তাদের রংবাহারি সৌন্দর্যের জন্য জগৎজুড়ে সমাদৃত। তাদের ডানার বর্ণচ্ছটা মুগ্ধ করে সবাইকে।

প্রজাপতি একধরনের পতঙ্গ। এটি লেপিডোপ্টেরা (Lepidoptera) বর্গের অন্তর্ভূক্ত। এদের পাখা, দেহ ও পা  বিভিন্ন ধরনের রঙিন আঁশ দিয়ে আবৃত। প্রকৃতিতে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। পরাগায়ন থেকে শুরু করে খাদ্যশৃঙ্খল—সবখানেই এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কবিতা-সাহিত্য থেকে ইকো-ট্যুরিজম—সবখানে এদের উপস্থিতি  উল্লেখযোগ্য। পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের (উপাদানের) তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মাটির গুণাগুণ, আলোক তীব্রতা ও উদ্ভিদের উপস্থিতির সামান্য পরিবর্তনের প্রতিও এরা সংবেদনশীল।

পৃথিবীতে প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির বেশি প্রজাপতি আছে। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রজাতি। প্রাণিবিদ ও প্রজাপতিবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন তুহিনের প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪২০ প্রজাতির বেশি প্রজাতি রয়েছে। আইইউসিএন বাংলাদেশের লাল তালিকার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রজাপতির প্রজাতি সংখ্যা ৩০৫টি। অর্থাৎ প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রজাপতির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নাম। নতুন নতুন অনুসন্ধান প্রতিনিয়ত দিচ্ছে নতুন প্রজাপতির খোঁজ। ফলে আমাদের প্রজাপতির তথ্যভান্ডার ক্রমাগত আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী, প্রজাপতিপ্রেমী ও আলোকচিত্রীদের কল্যাণে জানা যাচ্ছে নতুন প্রজাপতিদের সংখ্যা।

প্রাণিবিদ ও প্রজাপতিবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন তুহিনের প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪২০ প্রজাতির বেশি প্রজাতি রয়েছে

সম্প্রতি একটা নতুন প্রজাতির প্রজাপতি খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমী মো. সুমন। চলতি বছর ২০ অক্টোবর হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে থেকে তিনি চেঞ্জেবল গ্রাস ইয়েলো (Eurema simulatrix) নামে একটা প্রজাপতি রেকর্ড করেছেন। এটি পিরিডে (Pieridae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ভারতসহ মায়ানমার, কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা যায়।

এ ছাড়াও চলতি বছর মার্চে দেশের প্রজাপতির তালিকায় নতুন নাম সংযোজন করেন আরেক প্রকৃতিপ্রেমীর দল—সৈয়দ আব্বাস, শামীম আজাদ ও তানিম হোসেইন। তাঁরা দেশের উত্তর-পূর্ব এলাকার মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড ইকো পার্ক থেকে রেকর্ড করেন স্পটেড রয়্যাল (Tajuria maculata) নামে একটা প্রজাপতি। এটি লাইসিনেডি (Lycaenidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বৈশ্বিকভাবে ভারত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এদের দেখা মেলে। 

এ বছর অটাম লিফ (Doleschallia bisaltide) এবং আনব্রোকেন সার্জেন্ট (Athyma pravara)নামে আরও দুটি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। দুটোই নিমফালিডি (Nymphalidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে প্রথমটা পাওয়া যায় ভারত, চীন, ভুটান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনিসহ বিভিন্ন দেশে। আর দ্বিতীয়টা এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দেখা যায়। দুটো প্রজাতিই চলতি বছর মার্চে মৌলভীবাজারের আন্তঃদেশীয় বন রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে রেকর্ড করেছেন মাহমুদুল হক ওলি, নাঈম-উর-রশিদ, ইমরুল কায়েস, উম্মে খাদিজা ও আরিফ হোসেইন।

আরও পড়ুন
১ / ৪
গ্রিন ভিনেড হোয়াইট (Pieris melete)সূত্র: লেখক

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি থেকে দুটি নতুন প্রজাতির প্রজাপতি রেকর্ড করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তিন তরুণ শিক্ষার্থী সাইদুল আমিন ফয়েজ, রাকিব হাসান ও দিপ্ত বিশ্বাস। প্রজাপতি দুটি যথাক্রমে পিরেডে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এশিয়ান গ্রিন ভিনেড হোয়াইট (Pieris melete) ও লাইসিনেডি পরিবারের অন্তর্ভূক্ত স্মল পয়েন্টেড পিয়েরো (Niphanda cymbia)। দুটি প্রজাতিই ভারত, রাশিয়া ও চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে পাওয়া যায়।

২০২৩ সালের মার্চে প্রজাপতিপ্রেমী মাহমুদুল হক ওলি দেশের আন্তঃদেশীয় বন রাজকান্দী সংরক্ষিত বন থেকে চেইন সোর্ডটেইল (Graphium aristeus) নামে আরও একটি প্রজাপতি খুঁজে পান। এটি প্যাপিলিয়নিডি (Papilionidae) পরিবারের অন্তর্ভূক্ত।

দেশের জীববৈচিত্র্যের পরিপূর্ণ এক আন্তঃদেশীয় বন এই রাজকান্দী সংরক্ষিত বনাঞ্চল। প্রায় প্রতি বছরই এ বনে নতুন নতুন প্রজাপতি দেখা যায়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নাঈম-উর-রশিদ, মো: ইমরুল কাসেস, মাহামুদুল হক ওলি ও উম্মে খাদিজা সেখান থেকে ওয়েভি ম্যাপলেট (Chersonesia intermedia) ও কমন ম্যাপলেট (Chersonesia risa) প্রজাতির প্রজাপতি রেকর্ড করেন। দুটিই নিমফালিডি পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। বৈশ্বিকভাবে এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রয়েছে।

আরও পড়ুন
লার্জ ইয়েওম্যান (Cirrochroa aoris)
সূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

২০২৩ সালের নভেম্বরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার মৌলভীবাজারের চিরহরিৎ বন থেকে লার্জ ইয়েওম্যান (Cirrochroa aoris) নামে আরও একটা প্রজাপতি রেকর্ড করেন। সেটি নিমফালিডি পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশ এর আগে কমন ইয়েওম্যান (Cirrochroa tyche) ও ব্যান্ডেড ইয়েওম্যান (Cirrochroa orissa)-এর রেকর্ড থাকলেও তানিয়া আক্তারের পাওয়া প্রজাপতিটি ছিল নতুন প্রজাতির। বৈশ্বিকভাবে এটি ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়।

ব্রাইট বাবুল ব্লু (Azanus ubaldus)
সুত্র: উইকিপিডিয়া

ব্রাইট বাবুল ব্লু (Azanus ubaldus) ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী সামাজিক বনায়ন এলাকায় খুঁজে পান প্রজাপতিপ্রেমী আকাশ মজুমদার, নাঈম-উর-রশিদ, মো. ইমরুল কায়েস, উম্মে খাদিজা ও মো. নাজমুল হাসান। লাইসিনেডি পরিবারের আরও তিন প্রজাতির প্রজাপতি ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এটিই প্রথম। ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে এদের দেখা মেলে।

দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার বনেও বৈচিত্র্যময় প্রজাপতি রয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আকাশ মজুমদার নীলগিরি ফরেস্ট থেকে ফাওচেট’স পিয়েরো (Niphanda asialis) নামে একটা প্রজাপতি রেকর্ড করেন। এটি ভারত, মিয়ানমার, লাওস ও ভিয়েতনামে পাওয়া যায়। গত তিন বছরে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বনাঞ্চল থেকে এই গণের দুটি প্রজাতি রেকর্ড করা হয়েছে। একটা হলো ফাওচেট’স পিয়েরো ও অন্যটি স্মল পয়েন্টেড পিয়েরো।

স্লেট আওল (Hasora anura)
সূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

২০২১ সালের মার্চে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে যাই আমরা। সেখানে শীতের সকালে প্রজাপতি দেখার উদ্দেশ্যে বের হই। হঠাৎ সামনে উড়ে এসে বসে এক নতুন ধরনের প্রজাপতি। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম দুজনে। পরে দেখা যায়, এটা নতুন প্রজাতির প্রজাপতি। এর নাম দেওয়া হয় স্লেট আওল (Hasora anura)। এটি হেসপেরিডি (Hesperiidae) পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। ভারতসহ চীন, হংকং ও তাইওয়ানে এটি পাওয়া যায়।

রাজকান্দী সংরক্ষিত বনের পাশাপাশি ছড়া, ঝিরি, প্রাকৃতিক বন ও বনের তরুলতা প্রজাপতির আবাসস্থল হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে এই বন প্রজাপতির সমৃদ্ধ আবাসস্থল হিসেবে টিকে আছে। পাশাপাশি এই বনগুলো সীমাবদ্ধবর্তী ও যাতায়াতে সমস্যার কারণে বিস্তৃতভাবে বনগুলো প্রজাপতি বা জীববৈচিত্র্য অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে যেগুলো ম্যাক্রোইনভার্টিব্রেট জাতীয় প্রাণী, সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান কম হয়েছে এসব এলাকায়। তবে যেহেতু আন্তঃসীমানা এলাকার বনে প্রজাপতি পাওয়া যাচ্ছে, তাই বোঝা যায় যে আগে এই অঞ্চলে এসব প্রজাতির আরও বিস্তৃতি ছিল। হয়তো মানবসৃষ্ট কারণে আজ সেগুলো হারিয়ে যাওয়ার পথে। ফলে কালে-ভদ্রে এর দেখা মিলছে। আবার কোনোটা একবারের পর আর দেখা যায়নি।

আসলে প্রজাপতি প্রকৃতির সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। প্রাকৃতিক পরিবেশের সামান্য পরিবর্তন ঘটলে এদের ওপর বড় প্রভাব পড়ে। ফলে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে এসব প্রজাপতি। তাই এদের সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে।

দেশে মেগাফনা বা হাঙরের মতো বড় সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, ঠিক ততটা গুরুত্ব ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণীদেরও দেওয়া উচিত। তা না হলে এগুলো খুঁজে পাওয়ার আগেই আবার হারিয়ে যাবে। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবী।

লেখক: আশিকুর রহমান, পরিবেশবিদ ও বন্যপ্রাণী গবেষক এবং দিপ্ত বিশ্বাস, বন্যপ্রাণী বিষয়ে গবেষণারত শিক্ষার্থী