গিরগিটি ও অক্টোপাস কীভাবে দেহের রং বদলায়?

পানির দানব অক্টোপাস আর স্থলবাসী সরীসৃপ গিরগিটি। স্বভাব ও শারীরিক বিভিন্ন পার্থক্য থাকলেও খুব অদ্ভুত এক জায়গায় তাদের মিল। প্রাণী দুটোই দারুণ ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বদলে ফেলতে পারে নিজেদের ত্বকের রং ও রঙের শেড। বিস্ময়কর শারীরিক গঠন ও সমন্বয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই জীব দুটি প্রয়োজন অনুযায়ী কাজটি সম্পন্ন করে। আসুন জেনে নিই, অক্টোপাস আর গিরগিটি কীভাবে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের রং বদলায়।

প্রথমে অক্টোপাসের কথা বলি। ছদ্মবেশ ধারণের ক্ষেত্রে এ জলদানব অতুলনীয়। ত্বকের রং আর শারীরিক গড়ন পরিবর্তন করে এবং সুনিয়ন্ত্রিত স্নায়বিক ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিকূল পরিবেশে আত্মরক্ষা করে। পাশাপাশি শিকার করার সময়ও ছদ্মবেশ নেয় এগুলো। অক্টোপাসের ত্বকের ঠিক নিচে একধরনের কোষস্তর রয়েছে ক্রোমাটোফোর নামে। প্রজাতি ভেদে এ কোষগুলোয় লাল, হলুদ, খয়েরি, কালোসহ নানা রঙের যৌগসমৃদ্ধ উপাদান থাকে। অক্টোপাস বাইরের পরিবেশ দেখে, সে অনুসারে চোখ থেকে মস্তিষ্কে সিগন্যাল যায়। এ সিগন্যাল থেকে বাইরের পরিবেশের রঙের ধরন ও উজ্জ্বলতা অনুযায়ী নিজের ত্বকের রং বদলে নেয় এ প্রাণী।

আর ক্রোমাটোফোর কোষগুলোর ঠিক নিচে থাকে ইরিডোফোর নামে আরেক ধরনের বিশেষায়িত কোষের স্তর। এ কোষের ভেতরে রিফলেক্টোসোম নামে একধরনের কোষীয় উপাদান থাকে, যেগুলো কাজ করে আয়নার মতো! রিফলেক্টোসোম বাইরের পরিবেশের আলোর সঙ্গে মিল রেখে প্রায় একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলন করতে পারে। ফলে আশপাশের বস্তুগুলোর রং ধারণ করে ফেলতে পারে এগুলো। একইসঙ্গে রিফলেক্টোসোম প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রোমাটোফোর কোষগুলোর রঙিন যৌগগুলোর উজ্জ্বলতা আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মূলত যেসব রঙের উপাদান ক্রোমাটোফোর কোষগুলো তৈরি করতে পারে না, ত্বকে সেসব রং ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ইরিডোফোর কোষগুলো।

অক্টোপাস

অক্টোপাসের ইরিডোফোর কোষের নিচে আরও একধরনের বিশেষ কোষ থাকে। এগুলোকে বলা হয় লিউকোফোর। এ কোষগুলো পরিবেশ থেকে ত্বকে আসা আলো চারদিকে বিচ্ছুরণ করতে পারে। তা ছাড়া বাইরের পরিবেশের আলোর ধরন ও রং অনুসারে নির্ধারণ করতে পারে বিচ্ছুরিত আলোর বৈশিষ্ট্য। লিউকোফোর কোষের কার্যক্রমে ইরিডোফোর কোষ অনেকখানি সাহায্য করে।

এই হলো অক্টোপাসের রং পরিবর্তনের রহস্য। এখন আসি গিরগিটির রং বদলানোর কথায়।

গিরগিটির ত্বকের বাইরের স্তর স্বচ্ছ। তার নিচে থাকে ক্রোমাটোফোর কোষের স্তর, যেখানে বিভিন্ন রংবিশিষ্ট যৌগ উপাদান তৈরি হয়। অক্টোপাসের মতোই, গিরগিটিও প্রয়োজন মতো ক্রোমাটোফোর কোষের অভ্যন্তরীণ রঙিন উপাদানগুলো ব্যবহার করে ত্বকে নির্দিষ্ট রং ফুটিয়ে তোলে। তবে গিরগিটির ক্রোমাটোফোর কোষগুলোর নিচে থাকে মেলানোফোর কোষ। এগুলোতে থাকে বাদামি রঙের মেলানিন। এ মেলানিন গিরগিটির ত্বকের শেড নির্ধারণ করে। পাশাপাশি ত্বকের ক্রোমাটোফোর কোষের প্রদর্শিত রঙের উজ্জ্বলতাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এগুলো।

গিরগিটির ত্বকের ভেতরে আরও থাকে ইরিডোফোর। অক্টোপাসের মতোই এগুলো আশপাশের পরিবেশের আলোর সঙ্গে মিল রেখে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলিত করে। পাশাপাশি বিশেষায়িত কোষ, যেমন ব্লু ইরিডোফোর—নীল, জেনথোফোর—হলুদ আর ইরাইথ্রোফোর—লাল বর্ণের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়।

কিন্তু এরকম রং বদলানোর কারণ কি শুধুই শিকার ধরা ও আত্মরক্ষা? আসলে আত্মরক্ষা ও শিকার ধরার কাজে প্রয়োজন পড়ে ঠিকই, তবে মজার বিষয় হলো, গিরগিটি মূলত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য গিরগিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যম হিসেবে ত্বকের রং পরিবর্তনের ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। দেহের তাপ বেড়ে গেলে গিরগিটির ত্বক হালকা বর্ণ ধারণ করে, যাতে অতিরিক্ত তাপ সহজে দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করার মাধ্যমে শীতল হতে পারে দেহ। আবার দেহের তাপ কমে গেলে গিরগিটির ত্বক গাঢ় বা কালো বর্ণ ধারণ করে, যাতে সূর্যের আলো থেকে তাপ সহজেই শরীরে শোষণ করা সম্ভব হয়। তা ছাড়া গিরগিটিরা নিজেদের ভেতরে যোগাযোগের ভাষা হিসেবেও প্রয়োজন মতো ত্বকে বিভিন্ন রং প্রদর্শন করে।

লেখক: এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ১. aquarium.co.za/blog/entry/how-does-an-octopus-change-its-colour-and-shape

২. oceanconservancy.org/blog/2019/10/07/octopuses-change-color/

৩. scienceabc.com/nature/revealed-why-and-how-chameleon-change-its-colour.html

৪. https://www.wired.com/2014/04/how-do-chameleons-change-colors/