প্রাণীজগৎ
বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ১০ প্রাণী
১২ লাখ প্রজাতির পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ পৃথিবীতে টিকে আছে। কিন্তু অনেক প্রাণীই মানুষের জন্য হুমকিস্বরুপ। যে ১০টি প্রাণী মানুষের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক, চলুন সেগুলোর ব্যাপারে সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করি।
পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের বাস। এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। এ রকম আরও প্রায় ১২ লাখ প্রজাতির প্রাণী আছে পৃথিবীতে (মানুষসহ)। এর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বিপজ্জনক? আরও স্পষ্ট করে বললে, কোন প্রাণীটি সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী? সে প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটা ভুল ধারণা ভেঙে নেওয়া দরকার।
হলিউডের অনেক সিনেমায় দেখানো হয়, মানুষের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী সিংহ, কুমির, সাপ বা বাঘ। কিন্তু পৃথিবীতে এমন প্রাণীও আছে, যারা আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আবার উল্টোটাও হয়। হয়তো জানেন, হাঙরের আক্রমণে পৃথিবীতে অনেক মানুষ মারা যায়। কারণ হলিউডের অনেক সিনেমায় হাঙরকে বানানো হয়েছে খলনায়ক। কিন্তু এটা আসলে ঠিক নয়। হাঙরের আক্রমণে প্রতি বছর গড়ে ৭০ জনের মতো মানুষ মারা যায়। এরচেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যায় অন্য প্রাণীর আক্রমণে। সেটা এত বেশি যে আপনি হয়তো প্রাণীগুলোর নাম বা কত মানুষ মারা যায় এগুলোর হাতে, তার সংখ্যা কল্পনাও করেননি। তাহলে আমাদের জন্য কোন প্রাণী সবচেয়ে হুমকিস্বরূপ? চলুন বিবিসি সায়েন্স ফোকাস-এর মতে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ১০ প্রাণী সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১০. সিংহ (বছরে প্রায় ২০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
বনের রাজা সিংহ। ভাবতে পারেন, এই সিংহই তো সবচেয়ে বেশি মানুষ মারবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! কিন্তু আসলে সিংহের আক্রমণে অত মানুষ মারা যায় না। হ্যাঁ, সিংহের গর্জন শুনলে সত্যিই পিলে চমকে যাবে যে কোনো বীরের। এরা প্রায় ১১৪ ডেসিবলে গর্জন করতে পারে। ডেসিবল হলো শব্দের তীব্রতা মাপার একক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। সুতরাং, সিংহের গর্জনে পিলে না চমকে উপায় আছে!
গর্জন ছাড়াও এদের আছে ধারালো নখ। আক্রমণে সৃষ্টি হয় গভীর ক্ষত। কামড়ের জোর অত্যন্ত শক্তিশালী। এক কামড়ে মানুষের মাথার খুলি গুঁড়ো করে দিতে পারে। শিকার পেলে ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে। তবে সহজে মানুষের ওপর আক্রমণ করে না। মাঝেমধ্যে খিদে পেলে অবশ্য নিয়মের তোয়াক্কা না করেই আক্রমণ করে বসে। তবে সিংহের বাচ্চার দিকে নজর দিলে আর রক্ষা নেই। বাচ্চাকে বাঁচাতে এরা যেকোনো প্রাণীকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু বাংলাদেশে চিড়িয়াখানা ছাড়া যেহেতু সিংহ পাওয়া যায় না, তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আফ্রিকা ও ভারতে এই হিংস্র প্রাণীটির দেখা মেলে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা লিও (Panthera leo)।
৯. জলহস্তী (বছরে প্রায় ৫০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
জলহস্তিও আমাদের দেশের প্রাণী নয়। এদের শুধু চিড়িয়াখানায় দেখা যায়। এই তৃণভোজী প্রাণীটি কিন্তু ভীষণ রাগী। রেগে গেলে আধা মিটার লম্বা শিং দিয়ে গুঁতো মারে। এদের মুখ অনেক বড়। একবার হাঁ করে কেটে ফেলতে পারবে আপনার শরীরের অর্ধেকটা। কামড়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০ প্যাসকেল শক্তি থাকে, যা সিংহের চেয়ে তিন গুণ বেশি। বলে রাখি, চাপের একক প্যাসকেল।
এ প্রাণীও পাওয়া যায় আফ্রিকায়। মানুষের আবাসস্থলের কাছাকাছি চলে এলে নিজেদের নিরাপদ রাখতে আক্রমণ করে বসতে পারে। তবে কোনো কারণে রাগের মাত্রা চরমে উঠলে নিজেদের প্রজাতি, অর্থাৎ জলহস্তী খেতেও দ্বিধা করে না। জলহস্তীর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোপোটামাস অ্যাম্ফিবিয়াস (Hippopotamus amphibius)।
৮. হাতি (বছরে প্রায় ৬০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। স্মরণশক্তিও খুব ভালো। দেহের আকারের কারণে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সাধারণত মানুষকে পিষে মারে পায়ের নিচে। আফ্রিকান হাতির ওজন প্রায় ৮ হাজার কেজি। এর পায়ের নিচে পড়লে কী অবস্থা হবে, নিজেই চিন্তা করে দেখুন। এরা রেগে গেলে শুঁড়ের সাহয্যে মানুষকে ওপরে তুলে আছাড় মারে। এরকম পরিস্থিতে মৃত্যু অবধারিত। তবে হাতি একটু কমই রাগে। হরহামেশা এদের সামনে গেলেও আক্রমণ করে না। হাতির বৈজ্ঞানিক নাম এলেফাস ম্যাক্সিমাস (Elephas maximus)।
৭. কুমির (বছরে প্রায় ১,০০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
কুমিরের দাঁত দেখলেই কেমন ভয় ভয় লাগে। এদের দাঁত আসলেই মারাত্মক। তা ছাড়া হলিউডের সিনেমা দেখে সেই ভয় আরও পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে অনেকের মনে। বাস্তবেও এগুলোর দাঁতের কামড়ের শক্তি প্রায় ৫ হাজার প্যাসকেল। দেখা মেলে আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়। অনেক সময় পানিতে ডুব দিয়ে থাকতে পারে এই সরীসৃপ। শিকার পেলে ধীরে ধীরে ডুব দিয়ে এগিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে। তবে সিনেমার মতো এরা অত মারাত্মক নয়। কারণ মানুষ এদের এমনিতে ভয় পায়। ফলে সহজে কাছে যায় না। তাই মৃত্যুর হারও কম। কুমিরের বৈজ্ঞানিক নাম ক্রোকোডিলাস লরেন্টি (Crocodylus laurenti)।
৬. বিচ্ছু (বছরে প্রায় ৩,৩০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
এই প্রাচীন প্রাণীটি খুব ভয়ঙ্কর। অন্যান্য ভয়ঙ্কর প্রাণীর সঙ্গে এর একটি বিশেষ পার্থক্য আছে। সাধারণত সব প্রাণী আক্রমণ করে মুখ দিয়ে। তবে বিচ্ছু আক্রমণ করে লেজ দিয়ে। লেজে থাকে বিষ। তবে সব বিচ্ছু মানুষের জন্য মারাত্মক নয়। প্রায় ২ হাজার ৬০০ প্রজাতির মধ্যে ২৫ প্রজাতির বিচ্ছুর কামড়ে মানুষ মারা যেতে পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিচ্ছুর মধ্যে একটি হলো ডেথস্টকার। নামেই পরিচয় বোঝা যাচ্ছে। সাধারণত মরুভূমি ও জঙ্গলে বেশি দেখা মেলে। আকারে ছোট হওয়ায় সহজে চোখে পড়ে না। বিচ্ছুর বৈজ্ঞানিক নাম স্করপিয়নস (Scorpiones)।
৫. অ্যাসাসিন বাগ (বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
দক্ষিণ আমেরিকায় এই পোকা দেখা যায়। রক্তচোষা এ প্রাণী মানুষের জন্য খুব ভয়ঙ্কর। এর কামড়ে চাগাস নামে একধরনের রোগ হয়। সাধারণত এই কামড়েই মানুষ আক্রান্ত হয়। তবে পানি বা অন্য কিছুর সঙ্গে এর মল পেটে গেলেও সংক্রমণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, হার্ট, পাচনতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে এই রোগ। গর্ভাবস্থায় কোনো মায়ের এই রোগ হলে তার শিশুও সংক্রমিত হয়। অ্যাসাসিন বাগের বৈজ্ঞানিক নাম রাইনোসোরিস ইরাকুন্ডাস (Rhynocoris iracundus)।
৪. কুকুর (বছরে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী। মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু। তবে কুকুরের আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটা দেখলে ওসব বিশেষণ আর খাটবে না। আসলে বেশির ভাগ বাড়িতে কুকুর পাহারার দায়িত্বে থাকে। বাসায় নতুন বা অপরিচিত কেউ এলে শুরু করে চিৎকার। মাঝে মধ্যে দেয় কামড়ে। যদিও কুকুরের কামড়ে মৃত্যু হওয়া অস্বাভাবিক। কিন্তু এর ফলে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। ফলে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই প্রাণীটির দেখা পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও-এর মতে, জলাতঙ্কে মৃত্যুর প্রধান উৎস কুকুর। প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ কুকুরের কামড়ের কারণে জলাতঙ্কে ভুগে মারা যায়। কুকুরের বৈজ্ঞানিক নাম (Canis familiaris)।
৩. সাপ (বছরে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সাপ আছে। বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। বাংলাদেশে আছে প্রায় ৭৯ ধরনের সাপ। এর মধ্যে বেশির ভাগই বিপজ্জনক। এমন অনেক সাপ আছে, যার দুই ফোঁটা বিষেই একজন মানুষ মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। আবার পূর্ণবয়স্ক অজগর সাপ একজন মানুষকে সম্পূর্ণ গিলে ফেলতে পারে। অজগরের পেটে একবার গেলে হাড়গোড় সব ভেঙে যায় চাপে। দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় শিকারীর। এরা প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সাপের বৈজ্ঞানিক নাম (Serpentes)।
২. মানুষ (বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
হ্যাঁ, ঠিকই দেখছেন। প্রতি বছর এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীর হাতে প্রায় ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অন্যান্য প্রাণী যে কত মারা পড়ে মানুষের হাতে, তার হিসেব নেই। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা-র তথ্য মতে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী মোট মৃত মানুষের ০ দশমিক ৭ শতাংশ ঘটেছে মানুষের হাতে। আর মানুষের হাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় লাতিন আমেরিকার এল সালভাদরে। তবে মানুষ যে শুধু নিজ জাতিকে হত্যা করে, তা নয়। প্রাণিজগতের আরও অনেক প্রাণী আছে, যারা নিজ জাতিকে হত্যা করে। ওয়াইল্ড লাইফের ভিডিও দেখলেই তা বুঝবেন। সিংহ প্রায়ই আক্রমণ করে সিংহকে। মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম (Homo sapiens)
১. মশা (বছরে প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী)
সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণীটির নাম দেখে চমকে গেলেন? ভাবছেন, সামান্য মশা প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারে! মশাকে তো চট করে এক থাপ্পড় দিলেই হয়, সাঙ্গ হয় ওদের ভবলিলা। তাহলে মশা কীভাবে বিশ্বব্যাপী এত মানুষ মেরে ফেলছে?
আসলে এই ক্ষুদ্র মশাই পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী। ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। তবে সব মশা কিন্তু মানুষের জন্য বিপজ্জনক নয়। শুধু স্ত্রী মশা মানুষকে কামড়ায়। এদের ডিম পাড়ার জন্য প্রচুর শর্করার দরকার হয়। আর মশা সেই শর্করার অভাব পূরণ করে আমাদের রক্ত খেয়ে। রক্ত খেতে না পারলে মশা ডিম পাড়ে হাতেগোনা কয়েকটি। তাই বংশ বৃদ্ধি করতে মশার রক্ত খেতেই হয়। এ জন্য শুধু স্ত্রী মশাই মানুষকে কামড়ায়। আর পুরুষ মশা বিভিন্ন ফুলের মধু ও গাছের মিষ্টি নির্যাস খেয়ে বেঁচে থাকে। মশার বৈজ্ঞানিক নাম Culicidae।
মশা সম্পর্কে আরও একটা মজার তথ্য দিই। আইসল্যান্ডে ও অ্যান্টার্কটিকায় কোনো মশা নেই। আইসল্যান্ড পৃথিবীর একমাত্র মশাবিহীন দেশ। আর অ্যান্টার্কটিকায় অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে মশা বাঁচতে পারে না। অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ মেরুর গড় তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মানুষের পক্ষেই সেখানে বেঁচে থাকা মুশকিল, মশা বাঁচবে কীভাবে!