দেহঘড়ি
রক্তক্ষরণ ও আঘাতে যে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হবে
মাঝেমধ্যে আমরা সবাই দুর্ঘটনার মুখে পড়ি। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাই, রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করা গেলে বড় ধরনের সমস্যার হাত থেকে বাঁচা যায়। ‘দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা’ বইয়ে সেরকমই কিছু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ক্ষত সৃষ্টি, রক্তপাত, হাড় ভাঙ্গা, পুড়ে যাওয়া কিংবা সামান্য আহত হওয়ার ফলে যা যা হতে পারে, সেগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে এই বইয়ে। বইটি ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরপর ১৯৮২ সালে মির পাবলিশার্স মূল বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। ১৯৮৬ সালে দ্বিজেন শর্মার বাংলা অনুবাদে বইটি প্রকাশ করে মির প্রকাশন। বইয়ের লেখক ভ. ভ. ইউদেনিচ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
যথেষ্ট পরিমাণ রক্তপাত ঘটলে তীব্র রক্তাভাব দেখা দেয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ৫ লিটার রক্ত সঞ্চালিত থাকার প্রেক্ষিতে দেড় লিটারের বেশি রক্তপাত অবশ্যই মারাত্মক বটে। রক্তপাতের হারও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বড় আকারের কোনো ধমনীর ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ সবিশেষ বিপদজনক।
পুরুষের তুলনায় নারীর পক্ষে রক্তক্ষয় সহ্য করা সহজতর। এক বছরের কম বয়সী শিশুর পক্ষে ২৫০-৩০০ মিলিলিটার রক্তক্ষয় খুব মারাত্মক।
প্রচুর রক্তক্ষয়ের ফলে তীব্র রক্তাভাবের লক্ষণ দেখা দেয়। রোগী সাধারণ অস্বস্তি, পিপাসা ও মাথাঘোরা এবং চোখে অন্ধকার দেখার অভিযোগ করে। ঠোঁট ও চোখের পাতার চামড়া ও শ্লৈষ্মিকঝিল্লি খুবই ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে, চোখ কোটরগত হয়, হাই উঠতে থাকে, মুখের গড়ন ছুঁচাল হয়, কপালে ঠান্ডা ঘাম দেখা দেয়, নাড়ির বেগ বেড়ে মিনিটে ১২০ পর্যন্ত পৌঁছায়। তারপর দুর্বল হয়ে পড়ে ও শেষে নাড়ি পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। রক্তচাপ কমে যায়। অতঃপর দেখা দেয় সংজ্ঞাহীনতা, চোখের মণির স্ফীতি, অসাড়ে মূত্রপাত ও মলত্যাগ। এ ধরনের রোগী তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা-সাহায্য না পেলে মস্তিষ্কের অক্সিজেন ক্ষুধাজনিত কারণে শ্বসন ও রক্তসঞ্চালন কেন্দ্রগুলির পক্ষাঘাতে তার মৃত্যু ঘটা সম্ভব। উপরোক্ত পদ্ধতির যেকোনো একটির সাহায্যে বাহ্যিক রক্তপাত তৎক্ষণাৎ বন্ধ করা প্রয়োজন। তারপর রোগীকে যথেষ্ট পানীয় দেওয়া উচিত।
ঠোঁট ও চোখের পাতার চামড়া ও শ্লৈষ্মিকঝিল্লি খুবই ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে, চোখ কোটরগত হয়, হাই উঠতে থাকে, মুখের গড়ন ছুঁচাল হয়, কপালে ঠান্ডা ঘাম দেখা দেয়, নাড়ির বেগ বেড়ে মিনিটে ১২০ পর্যন্ত পৌঁছায়।
রক্তসঞ্চালনের ঘাটতির দরুন মস্তিষ্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্বসন ও রক্তসঞ্চালন-স্নায়ুকেন্দ্রগুলো প্রথমেই সঙ্কটাপন্ন হয়। সেজন্য মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক। বিছানার পায়ের দিক উঁচু করে ও মাথার বালিশ সরিয়ে রোগীকে এমনভাবে শোয়ানো উচিত যাতে তার মাথাটি পায়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিচে থাকে। এতে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন ত্বরান্বিত হয় এবং রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য কিছুটা সময় পাওয়া যায়। হাসপাতালে রক্তক্ষরণ পুরোপুরি বন্ধ করার পর রোগীকে রক্তভরণ দেয়া হয়।
আঘাতজনিত অভিঘাত
মারাত্মক যান্ত্রিক আঘাত (যৌগিক অস্থিভঙ্গ বা হাড় ভাঙা, বিশেষত বন্দুকের গুলিতে অস্থিভঙ্গ, প্রত্যঙ্গ ছিড়ে-যাওয়া, অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ বিদারণ) থেকে জায়মান বিক্রিয়া শরীরের অতিগুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ বন্ধ হওয়ার অবস্থা হিসাবে প্রকটিত হতে পারে। এই অবস্থাকেই অভিঘাত (শক) বলে।
অভিঘাতজনিত এই পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ এখনো সঠিকভাবে না জানা গেলেও রক্তক্ষয় ও স্নায়ুতন্ত্রের অত্যধিক উত্তেজনা এতে অবশ্যই যথেষ্ট ইন্ধন যোগায়। রক্তচাপ হ্রাস ও প্রান্তিক রক্তনালীগুলির সঙ্কোচন কোষকলার পুষ্টিতে বিঘ্ন ঘটায় ও অক্সিজেন-বুভূক্ষা সৃষ্টি করে। আহত এলাকায় প্রোটিনভঙ্গ ও বিপাকক্রিয়ার বিঘ্নজনিত উৎপন্ন বিষাক্ত পদার্থ শোষিত হওয়ার ফলে রোগীর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।
প্রখ্যাত রুশ সার্জন ন. ই. পিরোগভ আঘাতজনিত অভিঘাতের নিদানিক ছবির একটি চিরায়ত বর্ণনা দিয়েছিলেন।
প্রচুর রক্তক্ষয়, হিমায়ন, ক্ষুধা, আহতকে অসতর্কভাবে স্থানান্তরজনিত পরোক্ষ আঘাত, খারাপ রাস্তায় অনুপযোগী যানবাহনে এবং যথাযোগ্য অবেদনক ও ভাঙ্গা-হাড়ে বন্ধফলক ছাড়া রোগী স্থানান্তর বস্তুত, অভিঘাতের বিস্তারে ইন্ধন যোগায়।
প্রখ্যাত রুশ সার্জন ন. ই. পিরোগভ আঘাতজনিত অভিঘাতের নিদানিক ছবির একটি চিরায়ত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি একে ‘অসাড়তা’ হিসাবে আখ্যায়িত করে লিখেছিলেন: ‘হাত বা পা কাটা এমন একটি অসাড় দেহ ক্ষতসজ্জা স্টেশনে অনড় অবস্থায় পড়ে আছে। সে যন্ত্রণায় চিৎকার বা কাতরাচ্ছে না, কোন অনুযোগ জানাচ্ছে না। কোন কিছুতেই সে শরীক হচ্ছে না, কিছুই দাবী করছে না। তার শরীরটি ঠান্ডা, মুখটি লাসের মতোই ফেকাশে। চাহনি স্থির ও দূরস্থ। নাড়ি খুবই সুক্ষ্ম, প্রায় পাওয়াই যায় না, কখনো থেমে থাকে। “অসাড়” ব্যক্তি মোটেই প্রশ্নের উত্তর দেয় না বা প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে ফিসফিস করে, যেন নিজের সঙ্গে কথা বলে। তার শ্বাস-প্রশ্বাসও প্রায় টেরই পাওয়া যায় না। ক্ষত ও চামড়া প্রায় অসাড়, কিন্তু ক্ষত থেকে উদগত কোনো বড় স্নায়ু কোনো কিছুর সাহায্যে উত্তেজিত করলে মুখপেশীর সামান্য কুঞ্চনের মাধ্যমেই কেবল সে সাড়া দেয়। কখনো কয়েক ঘণ্টা অবস্থাটি অব্যাহত থাকে, অন্যত্র আমৃত্যু কোনো পরিবর্তন ঘটে না।’
প্রথম মাত্রার অভিঘাত হলো প্রতিকারমূলক অবস্থা: ফ্যাকাশে ভাব ও দুর্বলতা, সাধারণ অবস্থা ভালো, নাড়ির স্পন্দন মিনিটে ৯০-১০০, সর্বোচ্চ রক্তচাপ পারদের ১০০ মিলিমিটারের বেশি।
অভিঘাতের তিনটি মাত্রা চিহ্নিতব্য। প্রথম মাত্রার অভিঘাত হলো প্রতিকারমূলক অবস্থা: ফ্যাকাশে ভাব ও দুর্বলতা, সাধারণ অবস্থা ভালো, নাড়ির স্পন্দন মিনিটে ৯০-১০০, সর্বোচ্চ রক্তচাপ পারদের ১০০ মিলিমিটারের বেশি। অভিঘাতের দ্বিতীয় মাত্রা আংশিক প্রতিকারমূলক অবস্থা: সাধারণ পরিস্থিতি খারাপ, দুর্বলতা, ফ্যাকাশে ভাব, উদ্বেগ, ঠান্ডা ঘাম, পিপাসা, বমি; নাড়ির স্পন্দন ১২০-১৪০, প্রায় গণনসাধ্য নয়; সর্বোচ্চ রক্তচাপ পারদের ৭০ মিলিমিটারের মতো। অভিঘাতের তৃতীয় পর্যায় হলো প্রতিকারহীন অবস্থা: সাধারণ পরিস্থিতি খুব খারাপ, সুস্পষ্ট দুর্বলতা ও ফ্যাকাশে ভাব, ঠান্ডা ঘাম, পিপাসা ও বমি, নাড়ির বেগ ১২০-১৬০, প্রায় গণনসাধ্য নয়, সর্বোচ্চ রক্তচাপ পারদের ৭০ মিলিমিটারের নিচে।
প্রাথমিক চিকিৎসা
যেকোনো রক্তপাত তৎক্ষণাৎ বন্ধ করা প্রয়োজন। বুকে হা-মুখ ক্ষত থাকলে (খোলা বায়ুসঞ্চিত ফুসফুসাবেষ্টক গহ্বর) জীবাণুনাশী পট্টি লাগান দরকার। অস্থিভঙ্গ থাকলে প্রত্যঙ্গকে অনড় রাখতে ও অবেদনক দিতে হয়। রোগীকে গরম রাখা উচিত এবং আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ আহত না হলে গরম চা, কফি, কিংবা এক চুমুক কড়া মদ বা ওয়াইন খেতে দেওয়া ভালো।