বাংলাদেশ চিরসবুজের দেশ। এই সবুজের মাঝে বাস করে নানা রকম কীটপতঙ্গ। হরেক রকমের কীটপতঙ্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রজাপতি ও মথ। আপনি কি কখনো মথ দেখেছেন? ধাঁধায় পড়ে গেলে সমস্যা নেই। মথ দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতোই। এরা নিজেদের অজান্তেই উদ্ভিদে পরাগায়ন ঘটায়। নানা রঙের এসব অমেরুদণ্ডী কীটপতঙ্গের দেখা মেলে দেশের আনাচে-কানাচে প্রায় সব জায়গায়।
মথ ও প্রজাপতি একই গোত্রের পতঙ্গ। খাদ্যের ধরন, খাদ্য গ্রহণের কৌশল, বিচরণ এমনকি জীবনচক্রেও প্রজাপতি ও মথের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। মথও প্রজাপতির মতো বাহারি রঙের। অনেকের কাছে তাদের আলাদা করা বেশ কঠিন বলে মনে হতে পারে। তবে তাদের আলাদা করে চেনার সহজ একটা উপায় আছে। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য ধরা পড়ে বিশ্রামের সময় বা কোনো ফুলে মধু সংগ্রহের সময়। এ সময় মথ তাদের ডানা ভূমির সঙ্গে সমান্তরালে রাখে। অন্যদিকে প্রজাপতি তার ডানাজোড়া রাখে ভূমির সঙ্গে লম্বালম্বি করে। আবার প্রজাপতির অ্যান্টেনা সামনের দিকে একটু গোলাকৃতির আর মথের অ্যান্টেনা সোজা আকৃতির যা সামান্য পালক যুক্ত। মথ ও প্রজাপতির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল প্রজাপতির দেহ পাতলা আর মথের দেহ পুরু আকৃতির। প্রজাপতির ডানা বাহারি হলেও মথের ডানা খানিকটা ধূসর। প্রজাপতির মতো এরা এতটা রঙের বিচ্ছুরণ ঘটায় না। এর আরেকটা কারণও আছে। বেশিরভাগ মথ রাতে সক্রিয় থাকে।
অনুকূল পরিবেশে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পেলে প্রজাপতি ও মথ—উভয়েই প্রজননে আগ্রহী হয়। এ সময় পুরুষ ও স্ত্রী পতঙ্গ নানান ভঙ্গিমায় একে অপরকে আকর্ষণ করে। এভাবে সম্পন্ন হয় এদের মিলন। মিলনের পরপরই স্ত্রী পতঙ্গ ডিম পাড়ার জায়গা খুঁজে বেড়ায়। সাধারণত লার্ভা বা ক্যাটারপিলারের (প্রজাপতির ছোট বাচ্চা) জন্য নিরাপদ ও বসবাসোপযোগী জায়গায় এরা ডিম পাড়ে। এসব ডিম এক ধরনের আঠালো পদার্থ দিয়ে সুরক্ষিত থাকে।
অনুকূল তাপমাত্রায় ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। লার্ভা দেখতে অনেকটাই পোকার মতো। তুলনা দেওয়ার জন্য শুঁয়োপোকার কথা বলা যায়। এ সময় এরা ধীরে উড়ে বেড়ায়। আর প্রচুর পরিমাণে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে দ্রুত। এদের দেহে সুতার মতো এক ধরনের অঙ্গ বের হয়।
তারপর শুরু হয় পিউপা দশা। এই দশায় লার্ভা বা ক্যাটারপিলারের দেহের চারপাশে এক ধরনের আবরণ সৃষ্টি হয়। একে বলে কোকুন (প্রজাপতির ছোট বাচ্চার দেহের বাইরের অংশ)। ক্যাটারপিলার কোকুনের মধ্যে নিশ্চল জীবনযাপন করে। এ সময় এদের দেহ নানারকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। পরিবর্তন শেষে তারা পরিণত হয় প্রায় পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গে। এবারে মুক্ত আকাশে ডানা মেলার পালা।
কোকুন কেটে বের হয়ে প্রকৃতিতে রঙের পরশ বুলিয়ে যায় একেকটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি। পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি যখন রঙে ঢঙে ডালে ডালে উড়ে বেড়ায়, তখন নানা রঙ ও নকশায় তারা সাজিয়ে তোলে প্রকৃতিকে। এদের রঙিন পাখা ও নজর কাড়া সৌন্দর্য সবাইকে আকৃষ্ট করে।
প্রজাপতিরা সাধারণত দেহের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ফুল-লতাপাতায় বসে ও খাদ্য সংগ্রহ করে। ফুলের নির্যাস প্রজাপতির প্রিয় খাবার। এরা ফুলের নির্যাস খাওয়ার সময় পায়ে পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এই পরাগরেণু এক ফুল থেকে আরেক ফুলে পতিত হয়ে সম্পন্ন হয় ফুলের পরাগায়ন। এ ধরনের পরাগায়নকে বলে পরপরাগায়ন।
পূর্ণাঙ্গ মথ কোকুন থেকে বেরোনোর পর নিশাচর জীবনযাপন করে। তবে কিছু কিছু মথ দিনেও ঘুরে বেড়ায়। প্রজাপতির মতো এরাও বাহারি রঙে ভরিয়ে তোলে বাংলার বন বনানী। যেসব ফুল রাতে ফোটে, সেসব ফুলের পরাগায়নে মথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার কিছু মথের দেহ নিঃসরিত বর্জ্য ব্যবহৃত হয় উন্নতমানের সিল্ক সামগ্রী তৈরিতে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রজাপতি পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশেও আছে প্রজাপতি পার্ক। এসব পার্কে প্রজাপতি বসবাসের উপযোগী করে জীবন্ত প্রজাপতির অসংখ্য প্রজাতি সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: প্রকৃতি ও জীবন