মশামুক্ত পৃথিবী

মশা! ছোট্ট এক প্রাণী। অথচ সে কিনা রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণীর তালিকায় ১ নম্বরে! হ্যাঁ, বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্য, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায় কেবল মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। এর অর্ধেকের কম পরিমাণ মৃত্যুর ভার বহন করে তালিকার ২ নম্বরে রয়েছে মানুষ। এ ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ মশাবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং সঙ্গে আরও নানা প্রাণীর মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তো রয়েছেই। মশার এমন প্রাণঘাতী ভূমিকার কারণে এ কথা মনে হতেই পারে, পৃথিবীর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে তুচ্ছ এবং বিরক্তিকর এই প্রাণীর? কেমন হতো, যদি একে চিরতরে নির্মূল করে দেওয়া যেত? হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরাও এমনটি চিন্তা করেছেন এবং এ–সংক্রান্ত নানা দিক তাঁদের পর্যালোচনায় রয়েছে।

মশা পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরা ১০ কোটি বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে বাস করে বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মশা তার জীবনচক্রের শুরুতে লার্ভা হিসেবে পানিতে থাকে। তখন এরা পানিতে বাস করা বিভিন্ন অণুজীবকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। আবার বিভিন্ন প্রকার মাছ, সরীসৃপ, পাখি ও পতঙ্গ পরিণত মশা এবং এদের লার্ভা খায়। মশা উদ্ভিদের পরাগায়নেও ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া শীতপ্রধান মেরু অঞ্চলে একধরনের মশা রয়েছে, সেগুলো সেখানকার খাদ্যশৃঙ্খলের অন্যতম প্রধান উপাদান। এ ছাড়া মশাগুলো ওই এলাকার বলগা হরিণের চলাচলে ঐতিহাসিকভাবেই বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। হরিণগুলো তাদের খাদ্যের জন্য মশকপ্রধান অঞ্চলগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এ ছাড়া বাস্তুসংস্থানে আরও বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে নানা রকম আন্তসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে মশা প্রকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রকৃতিতে মশার এই ভূমিকাগুলোর কোনোটিই আবশ্যিক নয়। মশা না থাকলেও প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খলে কিংবা উদ্ভিদের পরাগায়নে বিঘ্ন ঘটবে না। তবে মশা না থাকলে মশাবাহিত রোগের জীবাণুগুলোও তাদের বেঁচে থাকার জন্য নতুন কোনো প্রাণী খুঁজে বেড়াবে। সেটা আমাদের জন্য আরও বেশি বিপদের কারণ হয়ে উঠবে কি না, নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

তাহলে মনে হতে পারে, প্রকৃতিতে যেহেতু মশার তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান নেই, তাহলে তো মশা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে ফেলা যায়। এ কথা শুনে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন না যেন, আরেকটু ভাবুন। সাড়ে তিন হাজারের বেশি প্রজাতি নিয়ে গঠিত বৈচিত্র্যময় মশার জগৎ। এদের মধ্যে মাত্র কয়েক শ প্রজাতির মশা মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি কিংবা সরীসৃপের রক্ত পান করে থাকে। তবে মশা এই রক্তকে নিজেদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না; বরং তাদের ডিমের জন্য পুষ্টি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে। তাই কেবল স্ত্রী মশাই আমাদের রক্ত পান করে।

পুরুষ মশারা সাধারণত ফুলের মধু, উদ্ভিদ ও ফলের রস—এসব খেয়েই জীবন ধারণ করে। আবার যে কয়টি প্রজাতির মশা মানুষের রক্ত পান করে, তাদের মধ্যে কয়েক শ প্রজাতি প্রাণঘাতী রোগের জীবাণু বহন করে। অ্যানোফিলিস (Anopheles) গণভুক্ত মশার প্রায় ৪৬০টি প্রজাতির মধ্যে ১০০টির মতো প্রজাতি ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু প্লাসমোডিয়াম (Plasmodium) বহন করে। এই ১০০ প্রজাতির মধ্যে মাত্র ৫টি প্রজাতি সবচেয়ে বিপজ্জনক ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম (Plasmodium falciparum) বহন করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রজাতিটি হলো অ্যানোফিলিস গাম্বি (Anopheles gambiae)। সুতরাং এই একটি প্রজাতির মশাকে নির্মূল করতে পারলেই ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুর পরিমাণ বহুলাংশে কমানো সম্ভব। তেমনি এডিস (Aedes) গণভুক্ত বহু প্রজাতির মশা আছে। এগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টাই (Aedes aegypti) এবং এডিস অ্যালবোপিক্টাস (Aedes albopictus) প্রজাতি দুটি সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কারণ, এরা মানুষের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। এই দুই প্রজাতির মশাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, পীতজ্বর, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, এনকেফালাইটিসের মতো অনেকগুলো ভয়ংকর রোগের জীবাণু বহন করতে পারে। সুতরাং মশাবাহিত এতগুলো ভয়ংকর রোগ দমন করতে চাইলে পৃথিবীর সব মশাকে মেরে ফেলার দরকার নেই, গুটিকয় প্রজাতিকে দমন করাই যথেষ্ট।

এত এত প্রজাতির মধ্যে মাত্র কয়েকটি প্রজাতির মশা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কেন? কারণ, মানুষের জন্য ক্ষতিকর জীবাণুগুলো মশার জন্যও ক্ষতিকর। তাই অন্য সব প্রাণীর মতো মশার দেহেও জীবাণুকে প্রতিরোধ করার স্বাভাবিক কিছু প্রক্রিয়া কার্যকর থাকে। কিন্তু মানুষের জন্য ক্ষতিকর নির্দিষ্ট কিছু জীবাণু গুটিকয় প্রজাতির মশার সঙ্গে লাখ লাখ বছর ধরে অভিযোজিত হয়েছে। ফলে মশার দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করায় সক্ষম এই মশাগুলো। একটি জীবাণু মশার দেহে প্রবেশ করে প্রথম বাধার মুখোমুখি হয় মশার পৌষ্টিকতন্ত্রে। সেখানে মশা থেকে বেঁচে গেলে তখনই কেবল সে বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ পায়। এরপর জীবাণুকে পৌষ্টিকনালি থেকে বের হয়ে মশার দেহের অন্যান্য অংশেও সংক্রমণ ঘটাতে হয়। এই ধাপ ঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর জীবাণু মশার লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ করে। সেখানেও টিকে থেকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয় জীবাণুকে। এই ধাপগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হলে তবেই কেবল একটি জীবাণু–পরবর্তী একটি পোষকদেহে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়।

এ অবস্থায় মশাটি সুস্থ মানুষের রক্ত পান করার সময় তার লালায় থাকা জীবাণুগুলো সহজেই সেই সুস্থ মানুষের রক্তে প্রবেশ করে এবং তাকে সংক্রমিত করে ফেলে। একেক প্রজাতির মশার দেহে একেক রকমের জীবাণু প্রতিরোধ করার কৌশল একেক রকম। যেমন এইডসের জীবাণু এইচআইভি মশার পৌষ্টিকনালিতে পৌঁছানোর পরই হজম হয়ে যায়। ফলে মশার মাধ্যমে এইডসের জীবাণু ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আবার কোনো কোনো মশার ক্ষেত্রে জীবাণু মশক দেহে তার জীবনচক্র সম্পন্ন করে লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ করার আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। ফলে তখনো জীবাণুর সংক্রমণের আর কোনো সুযোগ থাকে না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মশাবাহিত রোগের জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার ব্যাপারটি প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত জটিল একটি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে মশার কোনো দোষ নেই! তাই কেবল গুটিকয় মশার প্রজাতির জন্য সব প্রজাতির মশাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কথা চিন্তা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। গণহারে নয়, কেবল আমাদের জন্য ক্ষতিকর নির্দিষ্ট প্রজাতির মশাগুলোকে চিহ্নিত করে দমন করার চেষ্টা করাই ভালো। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন। তাঁরা কার্যকর কীটনাশক আবিষ্কারের পাশাপাশি নানা প্রকার তেজস্ক্রিয় রশ্মি কিংবা ওলব্যাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে পুরুষ মশাকে বন্ধ্যকরণের চেষ্টা করছেন। ক্রিসপার প্রযুক্তির মাধ্যমে মশার জিনগত পরিবর্তন করে, মাছ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর সাহায্যে জৈব উপায়ে মশা দমন করে, মশা মারার ফাঁদ তৈরি করে, অভিনব পদ্ধতিতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে মশাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিলসহ বেশ কিছু দেশ এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলও হয়েছে ক্ষতিকর মশা দমনে। তবে বিশ্বজুড়ে সবাই একসঙ্গে এই চেষ্টাগুলো না করলে ক্ষতিকর মশার প্রজাতিগুলো চিরতরে নির্মূল করা কখনোই সম্ভব হবে না।

সব মিলিয়ে বলা যায়, মশাকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা উচিত কি না, এর জবাব দিতে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার পাশাপাশি নৈতিকতার বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত। কেননা পৃথিবীতে আরও লাখো-কোটি জীবের মতো মশাও একটি জীব এবং আমরা সবাই এই একই পৃথিবীর অধিবাসী। কিন্তু মানুষ মাঝেমধ্যে এ চরম সত্য ভুলে গিয়ে নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রাণী মনে করে প্রকৃতি ধ্বংসে লিপ্ত হয়। এটা কখনোই শুভ ফল বয়ে আনে না। তাই হয়তো মাঝেমধ্যে মশার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীরাও নানা রকম রোগবালাই নিয়ে হাজির হয়ে আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রকৃতির কাছে আমরা যে আর দশটি জীবের মতোই অতি সাধারণ একটি জীব ছাড়া আর কিছু নই, সে বাস্তবতাও দেখিয়ে দেয় চোখে আঙুল দিয়ে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার ও ফোর্বস