প্রাণীরা যেভাবে শরীর ঠান্ডা রাখে

প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে মানুষ অনেক কিছু করে। ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার, ছাতা, ঠান্ডা পানীয়র মতো নানারকম কৃত্রিম উপায়ের আশ্রয় নেয়। বিজ্ঞান যত উন্নতি করেছে, মানুষের এসব উপায়ও তত উন্নত হয়েছে। পাল্টে গেছে জীবনযাত্রার মান। আগে মানুষ মাটির পাত্রে রেখে পানি ঠান্ডা করত। রেফ্রিজারেটর আবিষ্কারের পরে পানি আরও বেশি ঠান্ডা করার উপায় পাওয়া গেল। এতে সময়ও লাগে কম। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। সে উষ্ণতা থেকে বাঁচতে মানুষের আবিষ্কৃত কিছু প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে জলবায়ু আরও খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। শরীরে ঘাম হয়। মস্তিষ্ক শরীরকে বার্তা পাঠায় শীতল হওয়ার জন্য। এরপর শরীরের বিভিন্ন স্থানের ঘামগ্রন্থি কাজে লেগে পড়ে। শরীরের মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা তখন ত্বকে লেগে থাকা ওই ঘামকে বাষ্পে পরিণত করে। আর এভাবেই আমাদের শরীর ঠান্ডা হয়। কিন্তু এরকম তীব্র গরমে প্রাণীরা কি করে? ওদের কি কষ্ট হয় না?

হ্যাঁ, প্রাণীদেরও কষ্ট হয়। তবে তাদের কাছে প্রযুক্তি নেই। তাই তারা নিজেরাই কিছু উপায় অবলম্বন করে আরাম করে। কখনও প্রকৃতি থেকে সাহায্য নেয়। আবার কখনো নিজের শরীরকে ব্যবহার করে শীতল থাকার চেষ্টা করে। আজ সেরকম শীতল থাকার কয়েকটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

ফেনেক শেয়াল

ফেনেক শেয়ালের বাস মরুভূমিতে। খেঁকশিয়াল, কুকর, নেকড়ে বা শিয়াল গোত্রের যেকোনো প্রাণীর তুলনায় ফেনেক শিয়ালের কান শরীরের আকারের তুলনায় সবচেয়ে বড়। বালুর তলায় শিকার খোঁজার জন্য নিজেদের কান ব্যবহার করে শিয়ালগুলো। এ ছাড়া দেহের তাপমাত্রা কমানোর ক্ষেত্রেও এরা কানের ব্যবহার করে। মরুভূমিতে বাস করা যেকোনো প্রাণীর জন্যই পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেনেক শিয়ালের বড় কানগুলো শরীর থেকে তাপ বাইরে বের করে দেয়। ফলে ঘামের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পানি বেরিয়ে যেতে পারে না। সাহারার মতো মরুভূমিতে তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরকম একটি জায়গায় শিয়ালের এ কৌশলটি খুব কাজে দেয়।

সাধারণত প্রাণীদের শরীরে থাকা পশমের মূল কাজ হচ্ছে শরীরকে গরম রাখা। কিন্তু হাতির ক্ষেত্রে পশম ঠিক উল্টো কাজ করে। এদের শরীরের ছোট ছোট পশম হাতির বিশাল দেহকে শীতল রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পশমগুলো শীতলীকরণ পাখা হিসেবে কাজ করে। একটি তারের ভেতর দিয়ে যেভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, সেভাবেই হাতির শরীর থেকে পশমগুলোও উষ্ণতা সরিয়ে দেয়, ছড়িয়ে দেয় পরিবেশে।

হাতি
কাঠবিড়ালী

কাঠবিড়ালীর শরীরেও আছে পশম। শীতকালে কাঠবিড়ালীর দেহকে উষ্ণ রাখতে পশম সাহায্য করে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে পশম দিয়ে বিশেষ উপকার হয় না। তবে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য কাঠবিড়ালী নিজেদের শরীরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কাঠবিড়ালীর থাবার (হাতের) কিছু অংশে শীতকালে পশম থাকলেও গ্রীষ্মকালে সেসব পশম উধাও হয়ে যায়। আর থাবার এ লোমগুলো দিয়েই কাঠবিড়ালী নিজেদের শরীর থেকে অতিরিক্ত তাপের কিছু অংশ বাইরে বের করে দেয়। তবে পরিমাণটা খুব সামান্য। ফলে বেশি গরম পড়লে কাঠবিড়ালিদের ছায়ায় আশ্রয় নিতে হয়। জলাশয়ের আশেপাশে থেকেও নিজেদের শরীর ঠান্ডা রাখে প্রাণীটি।

আপনারা নিশ্চয়ই সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদার কাহিনি পড়েছেন। উট দেখে লালমোহনবাবু ভেবেছিলেন, উট পাকস্থলী থেকে জলের ব্যবস্থা করে। ফেলুদা তার ভুল শুধরে দেন। লালমোহনবাবুর মতো অনেকেই ভাবতে পারেন, উঁটের কুঁজে পানি জমানো থাকে। কিন্তু উট আসলে তার কুঁজে সরাসরি পানি সঞ্চয় করে না। বরং কুঁজগুলোতে থাকে চর্বি। সে চর্বি থেকেই পানি তৈরি করে নেয় উট। এ প্রক্রিয়ায় উটের দেহও শীতল হয়। বাইরের পানি না খেয়েও উট কয়েক সপ্তাহ, এমনকি মাসও কাটিয়ে দিতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতি যাত্রায় ১০০ লিটার পর্যন্ত পানি পান করে উট।

উঁট
কুকুর

অনেক জাতের কুকুর আছে, যেগুলো ত্বকের মধ্য দিয়ে ঘামাতে পারে না। তাই এগুলো থাবা ও নাকের মধ্য দিয়ে তাপ নিঃসরণ করে। অনেক সময় কুকুরকে দেখা যায় জিভ বাইরে বের করে হাঁপাতে। এটিও তাদের দেহ শীতল রাখার একটি কৌশল। তাপমাত্রা বাড়লে কুকুর প্রতি মিনিটে ৪০০ বারের মতো শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতে পারে। জিভের মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত তাপ বাষ্পে পরিণত হয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। একই সময়ে ফুসফুসের গরম বাতাস বের করে দিয়ে বাইরের তুলনামূলক শীতল বাতাস গ্রহণ করে কুকুর। অনেক প্রাণীই নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হিটস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে পোষা প্রাণীর মালিকদের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয়। বেশি গরম পড়লে পোষা প্রাণীকে ঘরের ভেতরে রাখা উচিৎ। ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান বিভাগ, কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

সূত্র: ডয়েচে ভেল, উইকিপিডিয়া