মানুষ যেমন ভাষা শেখে, পাখিরাও শেখে গান

রামগাংরা পাখি এদের জীবনের প্রথম ১০-১১ মাসে বেশিরভাগ গান শিখে ফেলে

ভোর হলেই পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা হয়। এদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে সকাল-সন্ধ্যা। অনেক পাখি নিজের এলাকা চিহ্নিত করার জন্য ডাকাডাকি করে, যাতে অন্য পাখিরা এলাকা দখল করতে না পারে। অনেক পাখি দল বেঁধে বাসা বানায়। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য ডাকাডাকি করে। প্রজননকালে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিদের আকৃষ্ট করতে নানা সুরে গান গায়। কিন্তু পাখিরা এটা কীভাবে শেখে? মানুষের মতো এরাও কি একে অপরের কাছ থেকে শেখে? কারণ, একই প্রজাতির সব পাখির কিচিরমিচির একরকম নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা পরিবর্তিত হয়। যেমন বদলে যায় মানুষের ভাষা বা গান।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় পাখিদের গান বা কিচিরমিচির নিয়ে নতুন তথ্য জানা গেছে। এই গবেষণায় পাখির গানের উপর পপুলেশন ডায়নামিকস বা  জনসংখ্যার গতিশীলতারপ্রভাব দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞরা এক লাখের বেশি পাখির কিচিরমিচির রেকর্ড করে বিশ্লেষণ করেছেন। সেখান থেকে এদের গতিবিধি, বয়সভেদে কিচিরমিচির পরিবর্তনের মাধ্যমে গানের বৈচিত্র্য দেখা গেছে।

আরও পড়ুন
ব্রিটেনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, রামগাংরা পাখি এক ধরনের বিশেষ গানের জন্য বিখ্যাত। গবেষকরা তাঁদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল ব্যবহার করে আলাদা আলাদা পাখির গানের রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করেছেন।

গবেষকরা এই পরীক্ষার জন্য রামগাংরা (Parus major) নামে পাখি বেছে নেন। ইংরেজি নাম Great tit। তাঁরা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বের একটি শহর অক্সফোর্ডশারে তিন বছর ধরে ২০ হাজার ঘণ্টারও বেশি এই পাখির কিচিরমিচির রেকর্ড করেন। এই গবেষণার নাম রাখা হয়েছে উইথাম গ্রেট টিট। ৭৭ বছর ধরে রামগাংরা পাখিদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে ওই অঞ্চলে। গবেষকদের উদ্দেশ্য ছিল পাখিদের কোন গানগুলো বারবার গাইছে, কোনগুলো আর গাইছে না এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের গানের ভাণ্ডার কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝা।

অতি চঞ্চল ও কোলাহলপ্রিয় পাখি রামগাংরা। খাবার শিকারের জন্য চৈত্রের দুপুরে গাছের ডালে বিচরণ করছে পাখিটি। বড়শলা এলাকা, সদর উপজেলা, সিলেট, ৯ এপ্রিল
ছবি: আনিস মাহমদ

কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত এই নতুন গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞান বিভাগের নাইরো মেরিনো রেকাল্ড। তিনি বলেন, ‘মানবসমাজে যেমন আলাদা উপভাষা এবং সঙ্গীতের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, তেমনই কিছু পাখিরও স্থানীয় গানের সংস্কৃতি রয়েছে, যা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। আমাদের গবেষণা স্পষ্টভাবে দেখায়, পাখিদের জনসংখ্যার গতিবিধি, আলাদা আলাদা পাখির আগমন ও চলে যাওয়ার সময় কীভাবে এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। ফলে গানের বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন দেখা যায়।’

আরও পড়ুন

কিছু পাখি ওদের বাবার কাছ থেকে গান শেখে। আবার কিছু পাখি চারপাশের অন্যান্য পাখির কাছ থেকেও শেখে। তবে রামগাংরা পাখি এদের জীবনের প্রথম ১০-১১ মাসে বেশিরভাগ গান শিখে ফেলে। এদের দৈর্ঘ্যে ১৩ সেন্টিমিটার, ওজনও ১৩ গ্রাম। গবেষকেরা বলছেন, এই সময়টা পার হয়ে গেলে এদের গানের সংগ্রহ খুব বেশি বদলায় না।

রামগাংরা পাখি দৈর্ঘ্যে ১৩ সেন্টিমিটার, ওজনও ১৩ গ্রাম
ছবি: বেংট নাইম্যান/ উইকিমিডিয়া

ব্রিটেনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, রামগাংরা পাখি এক ধরনের বিশেষ গানের জন্য বিখ্যাত। গবেষকরা তাঁদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল ব্যবহার করে আলাদা আলাদা পাখির গানের রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করেছেন। এর মাধ্যমে আশেপাশের এবং পুরো পাখির দলের বিভিন্ন গানের মধ্যে কতটা মিল আছে, তা খুঁজে বের করেছেন। এতে গবেষকেরা পাখির দলে নতুন পাখির আগমন বা অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পাখির গানের বৈচিত্র্য শুধু সুন্দর নয়, ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ প্রচেষ্টাও করা দরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও দীর্ঘদিনের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পারছেন, কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতি নিজেদের অনন্য স্বভাব তৈরি করে এবং ধরে রাখে।

সূত্র: আর্থ ডটকম, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

 

নোট:

১. জনসংখ্যার গতিশীলতা হলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনো একটি অঞ্চলের জনসংখ্যার পরিবর্তনের ধারা। জন্মহার, মৃত্যুহার এবং অভিবাসনের মতো বিষয়গুলো কীভাবে জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করে তা এতে আলোচনা করা হয়।

আরও পড়ুন