চট্টগ্রামে ৮৮ ভাগই ডেন-২ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত: যৌথ গবেষণার ফল

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীফাইল ছবি

চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের ৮৮ ভাগই ‘ডেন–২’ ধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন, জানা গেছে গবেষণায়। ১১ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ‘ডেন-৩’ প্রকরণের ডেঙ্গু ভাইরাস। এ ছাড়া গত বছরের ডেঙ্গু রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৫০ ভাগ রোগীর দেহে ‘ডেন-২’-এর আরেকটি উপধরন ‘কসমোপলিটন লিনিয়েজ’ উপস্থিত। এই উপধরনটির কারণে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে, বাড়তে পারে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা। পাশাপাশি এতে মৃত্যুর শঙ্কাও বেশি বলে জানান গবেষক ও চিকিৎসকেরা। গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে চলমান গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চলমান এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আইসিডিডিআরবি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ। গত বছর ১ হাজার ৫০০ রোগী এবং এবার ২০০ রোগীর ওপর এ পর্যন্ত গবেষণার জন্য জরিপ চালানো হয়েছে।

এ বছর ডেঙ্গু যেন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩ হাজার ৬৫৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ২১৫ জনের।

চারটির মধ্যে ডেন-২ সবচেয়ে ভয়ংকর ও মৃত্যুর শঙ্কা বেশি বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। এ ধরনে আক্রান্তদের প্রচণ্ড জ্বর, বমি, ত্বকে র‍্যাশ, দ্রুত প্লাটিলেট (সঠিক উচ্চারণ ‘প্লেটলেট’) কমে যাওয়া; চোখের পেছনে, বিভিন্ন পেশি, হাড় ও সংযোগ স্থান বা জয়েন্টগুলোতে ব্যথাসহ আরও বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। তবে নিশ্চিত হতে অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে
আরও পড়ুন

চট্টগ্রামে পরিচালিত এ গবেষণা তাই ডেঙ্গুর বিভিন্ন প্রকরণ ও রোগটির বিষয়ে আরও বুঝতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এ গবেষণা বলছে, কসমোপলিটন উপধরনটির জন্যই চট্টগ্রামে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার বেড়ে গেছে, বেড়েছে মৃত্যুর হারও।

ডেঙ্গুর মোট ৪টি ধরন রয়েছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। এগুলোর মধ্যে জিনগত মিল রয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। বাকি ৩৫ শতাংশ ভিন্নতার কারণে প্রতিটি ধরন—ইংরেজিতে বলা হয় ‘সেরোটাইপ’—মানুষের রক্তে থাকা অ্যান্টিবডিগুলোর সঙ্গে ভিন্নভাবে মিথস্ক্রিয়া করে। এক ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেই ধরনটি থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় বটে, তবে অন্য ধরনগুলো থেকে বেশি দিন সুরক্ষা পাওয়া যায় না। ফলে ভিন্ন আরেকটি ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন রোগীরা। এর ফলে রোগের তীব্রতা ও মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। চারটির মধ্যে ডেন-২ সবচেয়ে ভয়ংকর ও মৃত্যুর শঙ্কা বেশি বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। এ ধরনে আক্রান্তদের প্রচণ্ড জ্বর, বমি, ত্বকে র‍্যাশ, দ্রুত প্লাটিলেট (সঠিক উচ্চারণ ‘প্লেটলেট’) কমে যাওয়া; চোখের পেছনে, বিভিন্ন পেশি, হাড় ও সংযোগ স্থান বা জয়েন্টগুলোতে ব্যথাসহ আরও বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। তবে নিশ্চিত হতে অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে।

এই গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৯ ভাগ রোগীই ‘ডেন-২’ সেরোটাইপে আক্রান্ত ছিল। এ বছর এই শতকরা আক্রান্তের হার বেড়ে হয়েছে ৮৮ শতাংশ।

কসমোপলিটন লিনিয়েজ বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। এ কারণে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পাওয়া আগের ধরনগুলোর চেয়ে চট্টগ্রামে পাওয়া কসমোপলিটন ধরনটি ভিন্ন। ফাইলোজেনেটিক বিন্যাস তথা তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেন-২–এর এই উপধরন মিয়ানমার এবং ভারতে রয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও পর্যটকদের মাধ্যমে তা চট্টগ্রামে আসতে পারে
— আদনান মান্নান, গবেষক ও অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ডেঙ্গু
ফাইল ছবি: বাসস

এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্স করার পর কসমোপলিটন লিনিয়েজ ধরন রয়েছে কি না, তা বলা যাবে বলে মনে করছেন গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান। তিনি বলেন, কসমোপলিটন লিনিয়েজ বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। এ কারণে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পাওয়া আগের ধরনগুলোর চেয়ে চট্টগ্রামে পাওয়া কসমোপলিটন ধরনটি ভিন্ন। ফাইলোজেনেটিক বিন্যাস তথা তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেন-২–এর এই উপধরন মিয়ানমার এবং ভারতে রয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও পর্যটকদের মাধ্যমে তা চট্টগ্রামে আসতে পারে।

গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৬৫ শতাংশ ছিলেন পুরুষ। আর আক্রান্তদের প্রতি পাঁচ জনের একজন ছিল শিশু।

এ ছাড়াও চট্টগ্রামের বেশ কটি এলাকাকে ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল পাঁচটি এলাকায়। বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং এবং বায়েজিদ বোস্তামী। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালী এবং কর্ণফুলী এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে।

ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান ও নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য  জিনোম সিকোয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে
—আবদুর রব, পরিচালক, এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন

প্রথম আলো সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ বছর চলতি মাস পর্যন্ত ২০০ রোগীর তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার ২ হাজার ৩৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। মারা গেছেন ২০ জন। এবার নগরের কোতোয়ালি ও বাকলিয়া এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া গেছে।

গত বছর মোট ১৪ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। তখন ১০৭ জন মারা গিয়েছিল।

এবার আরও অনেক রোগীর নমুনা নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্স করা হবে বলে গবেষকেরা জানান। জিনোম সিকোয়েন্সগুলো জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়া দুটি গবেষণাপত্র ইতিমধ্যে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন–এ গৃহীত হয়েছে।

আরও পড়ুন

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই গবেষণা দলে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সাত্তার ও  আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রব।

আবদুর রব বলেন, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান ও নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য  জিনোম সিকোয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।