ফলের রানি কলা

কলা সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এতে প্রচুর শর্করা, ভিটামিন (এ, বি ও সি), ক্যালসিয়াম, আয়রন বা লোহা ও পর্যাপ্ত খাদ্যশক্তি আছে। অন্যান্য ফলের তুলনায় কলা সহজলভ্য। দামেও সস্তা। ফলটি প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। তাই যে কোনো পেশার মানুষ সহজে এই ফলটি খেতে পারেন। উত্পাদন, স্বাদ ও সুগন্ধের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় কলাকে অনেকে ফলের রানি বলেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ, আসাম ও ইন্দোচীন কলার উত্পত্তিস্থান। কলা মিউস্যাসি (Musaceae) পরিবারের একটি একবীজপত্রী উদ্ভিদ। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতেই কমবেশি কলা গাছ দেখা যায়। তবে নরসিংদী, গাজীপুর, বগুড়া, যশোর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, বান্দরবন জেলায় সবচেয়ে বেশি কলা উত্পাদন হয়।

কলা গাছ বেরী (Berry) জাতীয় ফল উত্পাদন করে। এর প্রতিটি পুষ্পমঞ্জুরীতে উত্পাদিত ফলগুলোকে ছড়া বা কাদি (Bunch) বলে। প্রতিটি ছড়া আবার ৫-১৫টি ফানায় (Hand) বিভক্ত। অনেক অঞ্চলে ফানাকেও কাদি বলে। প্রতিটি ফানায় সাধারণত ১২-১৬টি কলা (Finger) থাকে।

মোচাসহ কলা

কলায় থাকে দুটি অংশ। ফলের ওপরের সবুজ আবরণকে বলা হয় কলার খোসা। আর ভেতরের নরম সাদা অংশকে বলে পাল্প। এই অংশ পরবর্তীতে পাকার পর ভোজ্য অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ খাওয়া হয়। একবার ফল দিয়ে কলাগাছ মারা যায়।

কলা গাছের গোড়া থেকে বের হয় একাধিক গুড়িচারা। এগুলো দিয়ে কলার বংশবিস্তার হয়। প্রতিটি দেশের কলার নিজস্ব জাত আছে। পৃথিবীতে যে জাতটি সবচেয়ে বেশি জন্মে, তার নাম নাম ‘গ্রো মিচেল’ (Gros michel)। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০-৫০টি জাতের কলার চাষ হয়। এর মধ্যে অমৃত সাগর, সবরী, কবরী, চাঁপা, সিঙ্গাপুরী বা কাবুলী, মেহের সাগর, এঁটে বা বিচি কলা, কাঁচকলা বা আনাজি কলা, জয়েন্ট গভর্নর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

মানবদেহের ক্ষয়পূরণ, পুষ্টিসাধন এবং দেহকে সুস্থসবল ও নিরোগ রাখার জন্য যেসব পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন, তার প্রায় সবগুলোই আছে কলায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, আহার উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কলায় ৭ গ্রাম প্রোটিন, ২৫ গ্রাম শর্করা, ০.৮ গ্রাম চর্বি ও ০.১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১ (থায়ামিন), ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ (রাইবোফ্লেভিন) ও ২৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। তা ছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কলায় থাকে ১৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৯০ মিলিগ্রাম লৌহ, ৮০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন (ভিটামিন এ) এবং ১০৯ কিলো ক্যালোরি খাদ্যশক্তি। পাকা কলা টাটকা ফল হিসেবে সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুষ্টি উপাদান অবিকৃত অবস্থায় আমাদের দেহ গ্রহণ করে। তাই নিয়মিত পাকা কলা ও অন্যান্য ফল খেলে পুষ্টি সমস্যা দেখা দেয় না।

কলায় যে লোহাজাতীয় পুষ্টি উপাদান আছে, তা রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। লোহার ঘাটতি পূরণে কলার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই লোহার অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত মহিলাদের জন্য কলা হতে পারে দুঃসময়ের বন্ধু। ভিটামিন এ ও বি-এর উত্কৃষ্ট উত্স কলা। এজন্য কলাকে বলা হয় মস্তিষ্কের খাবার। কলাতে কোনো ক্ষতিকারক কোলেষ্টেরল নেই। তা ছাড়া এতে নেই কোনো দ্রবণীয় চর্বি (স্যাচুরেটেড ফ্যাট)। কলায় আরও আছে হৃদযন্ত্রের পেশীর নিয়মিত স্পন্দন সৃষ্টিকারী পদার্থ পটাশিয়াম।

বর্তমানে চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কলা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। তাঁদের মতে, কলায় প্রচুর পটাশিয়াম আছে। এতে চর্বির পরিমাণ থাকে কম। উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য শুধু ওষুধের পরিবর্তে কলা জাতীয় ফল ও কম চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। এ ছাড়াও কলা মানসিক চাপ কমায়। একই সঙ্গে বৃদ্ধি করে মানসিক কর্মক্ষমতা। কলায় সোডিয়ামের পরিমাণ কম এবং পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এটি স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা কমায়। প্রতিদিনকার খাদ্যাভ্যাসে কলা রাখলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায় ৪০ শতাংশ। কলায় প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম থাকায় এটি মাথাব্যথার প্রাকৃতিক নিরামক হিসেবে কাজ করে।

সম্প্রতি আরও এক তথ্যে জানা গেছে, কলা অন্ত্রের, মুখের ও ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে দেহকে রক্ষা করে। কলায় আছে প্রচুর আঁশ। তাই পাকা কলা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এ ছাড়া সহজে হজম হয় বলে রোগীর পথ্য হিসেবে কলা অতুলনীয়। নরম ও মিহি হওয়ার জন্য পেটের সমস্যায় খুবই উপকারী এটি। অনেক দেশে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে কলা ব্যবহার করা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের জ্বর হলে ওষুধের বদলে কলা খাওয়ানো হয় অনেক অঞ্চলে। থাইল্যান্ডে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গর্ভবতী মায়েদের কলা খাওয়ার প্রচলন আছে। পেশী গঠনেও আছে কলার কার্যকর ভূমিকা। বিভিন্নভাবে কলা আমাদের রসনার স্বাদ মেটায়। দুধভাতে পাকা কলার জুড়ি মেলা ভার।

কলাবাগান
কলা যেমন পুষ্টিগুণে ভরপুর তেমনি এর আছে প্রচুর ওষুধি গুণ। শুষ্ক কাশি ও কিডনি রোগের ক্ষেত্রে পাকা কলা উপকারী।

সাধারণত বেশির ভাগ মানুষ সদ্যপাকা কলা খেতে পছন্দ করেন। কলা অতিরিক্ত পেকে গেলে এর চামড়ায় কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। আর এই দাগের কারণে বেশির ভাগ সময় অতিরিক্ত পাকা কলা কেউ খেতে চান না। কিন্তু কলা যখন অতিরিক্ত পেকে যায়, এর এন্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে এন্টিঅক্সিডেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই নিয়মিত পাকা কলা খান, আর সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।

কলা যেমন পুষ্টিগুণে ভরপুর তেমনি এর আছে প্রচুর ওষুধি গুণ। শুষ্ক কাশি ও কিডনি রোগের ক্ষেত্রে পাকা কলা উপকারী। কলার থোড়ের রস কলেরা রোগীয় তৃষ্ণা নিবারণে ও রক্ত বমি রোধের জন্য উপকারী। কলার কন্দমূল ও কাণ্ড দূষিত রক্ত বিশুদ্ধকরণে সাহায্য করে। সেদ্ধ কাঁচা কলা সিফিলিসের চুলকানি ও পোড়া ঘায়ে প্রলেপের জন্য উপকারী।

কলার ব্যবহারও বহুমুখী। সাধারণত বিশ্বে উত্পাদিত কলার অর্ধেক পরিমাণ পাকা অবস্থায় ফল হিসেবে খাওয়া হয়। আর বাকি অর্ধেক সবজি হিসেবে খাওয়া হয় রান্না করে। তবে বাংলাদেশে কেবলমাত্র সবজি হিসেবে কাঁচা কলার ব্যবহার প্রচলিত আছে। এ দেশে কলা ছাড়াও কলার থোড় এবং মোচা সবজি হিসেবে ব্যাপকভাবে খাওয়া হয়। কাঁচা কলা, কলার মোচা খাওয়া হয় ভর্তা, ভাজি এবং সবজি হিসেবে। এটি বেশ সুস্বাদু ও উপাদেয়। তাছাড়া কলার ভুয়া কাণ্ড, থোড় ও পাতা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে খাওয়ানো হয়।

কলা একটি লাভজনক ও অর্থকরী ফসল। স্বল্প পরিশ্রমে ও কম খরচে কলা চাষ করা যায়।

টাটকা ফল হিসেবে খাওয়া ছাড়াও পাকা কলা ময়দা বা চালের গুড়ার সঙ্গে পিষে সুস্বাদু ও মুখরোচক কলার পিঠা তৈরি করা হয়। কলা থেকে আবার তৈরি করা যায় কেক এবং বড়া। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে কলা পাতলা করে কেটে রোদে শুকিয়ে চিপস তৈরি করা হয়। আজকাল কলা আর দুধ মিশিয়ে মজাদার আইসক্রিম তৈরি করে খাওয়ার রীতি প্রায় সব দেশেই প্রচলিত।

কলা একটি লাভজনক ও অর্থকরী ফসল। স্বল্প পরিশ্রমে ও কম খরচে কলা চাষ করা যায়। খনা বলেছিলেন—‘কলা না রুয়ে কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’। খনার বিখ্যাত এই বচনটি নির্দেশ করে কলার অর্থকরী দিকের কথা। এর ফলনও অন্যান্য ফল ও ফসল থেকে অনেক বেশি। তাই কলা চাষ করে সহজেই আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়া যায়। সুতরাং, খাদ্য ও পুষ্টি, ফলের চাহিদা পূরণ, দেহকে সুস্থসবল ও নিরোগ রাখার জন্য এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে বেশি করে কলা চাষ করা প্রয়োজন।

লেখক: লেখক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা