পাখি মানেই উড়তে পারে, এমন একটা ধারণা আমাদের অনেকের মধ্যে আছে। কিন্তু ধারণাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। কেননা সব পাখি আকাশে ওড়ে না। পাখি হতে হলে ওড়ার পাশাপাশি আরও কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি। উটপাখি, পেঙ্গুইন ও কিউইসহ প্রায় ৬০ প্রজাতির পাখি উড়তে পারে না। অর্থাৎ এদের সংখ্যা মোট পাখির প্রজাতির ১ শতাংশেরও কম। মাটি ও পানিতে থাকতে থাকতে এরা ওড়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু কেন এরা এখন উড়তে পারছে না?
বিজ্ঞানীদের ধারণা, পাখিরা উড়তে শিখেছে শিকারির হাত থেকে বাঁচতে, খাবার খুঁজতে এবং বসবাসের উপযোগী স্থানের সন্ধানে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে। কিন্তু আকাশে উড়তে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। একই আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় পাখিরা প্রতিদিন প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি শক্তি খরচ করে।
পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর কেনিয়ন কলেজের জীববিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নাটালি রাইট। তিনি জানান, ‘পাখিদের ওড়া না লাগলে ওরা সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে পারত।’
হালকা ও কম ওজনের হাড়ের কারণে পাখি উড়তে পারে। হালকা হাড় ওড়ার ধকল নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী। মজার ব্যাপার হলো, পাখির হাড় এত হালকা যে পাখির সব পালকের চেয়ে এর কঙ্কালের ওজন কম।
যুক্তরাষ্ট্রের পিএনএএস জার্নালে ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে নাটালি রাইট এবং তাঁর সহকর্মীরা জানান, ‘যেসব পাখি দ্বীপে বাস করে, সেসব পাখির শিকারির সংখ্যা কম। খাবার ও বাসস্থানের জন্যও তেমন প্রতিযোগিতা নেই। এই পাখিদের শিকারি থেকে বাঁচতে ও অন্যান্য কাজে ওড়ার প্রয়োজন হয় না। ফলে এমন স্থানের পাখিরা ধীরে ধীরে ওড়া ছেড়ে দেয়।’
পাখিরা উড়তে না পারলে নানারকম শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। একপর্যায়ে এদের বুকের ফ্লাইট মাসল বা ওড়ার উপযোগী পেশি ছোট হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, পাখির হাড়গুলোও বেশ ফাঁপা ও হালকা ধরনের। এই হালকা ও কম ওজনের হাড়ের কারণে পাখি উড়তে পারে। হালকা হাড় ওড়ার ধকল নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী। মজার ব্যাপার হলো, পাখির হাড় এত হালকা যে পাখির সব পালকের চেয়ে এর কঙ্কালের ওজন কম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে না ওড়ার কারণে ডানার হাড়—হিউমেরাস, উলনা এবং কার্পোমেটাকার্পাস ছোট ও দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে এদের পা মাটিতে চলাচলের জন্য লম্বা ও শক্ত হয়ে ওঠে। ফলে এরা আর উড়তে পারে না। উট পাখির ক্ষেত্রে এটাই দেখা যায়।
কিছু পাখি পানিতে সাঁতারের সুবিধার জন্য ওড়ার ক্ষমতা হারায়। যেমন, পেঙ্গুইনরা এদের ওড়ার পেশি এবং ডানা সাঁতারের জন্য ব্যবহার করে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখিবিদ্যার ইমেরিটাস অধ্যাপক পিটার রায়ান বলেন, ‘এরা পানির নিচে উড়তে ডানা ব্যবহার করে।’ উড়তে না পারা গ্রেট আউক (Pinguinus impennis) পানির মধ্যে চলার জন্য ডানা ব্যবহার করত। এরা ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পিএনএএস জার্নালে ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে নাটালি রাইট এবং তাঁর সহকর্মীরা জানান, ‘যেসব পাখি দ্বীপে বাস করে, সেসব পাখির শিকারির সংখ্যা কম। খাবার ও বাসস্থানের জন্যও তেমন প্রতিযোগিতা নেই।
রায়ান আরও বলেন, ‘যেসব পাখি দীর্ঘকাল ধরে উড়তে পারে না, এদের ওড়ার জন্য প্রয়োজনীয় লম্বা ও শক্ত পালকগুলোও হারিয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডের জাতীয় পাখি কিউই এবং আইল্যান্ড রেলের (Atlantisia rogersi) মতো কিছু প্রজাতি পালকের বারবিউল হারায়। বারবিউল হলো ক্ষুদ্র হুকের মতো গঠন। এটা পাখির ডানা ঝাপটাতে সাহায্য করে। বারবিউল হারানোর ফলে পাখিদের পালকগুলো তুলতুলে ও পশমের মতো দেখায়।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ইভোল্যুশন জার্নালে ২০২৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা গেছে, উড়তে না পারা পাখিরা প্রথমে মাটিতে চলাফেরা শুরু করে। ধীরে ধীরে ডানার পালক ও পেশির মাংস কমে যায়।
সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত ২০২০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানুষের কারণে বিলুপ্তি না ঘটলে পৃথিবীতে আজ চারগুণ বেশি উড়তে না পারা পাখি প্রজাতি থাকত।