পাকা জামের মধুর রসে

মে-জুন মাসে জাম ফল হয়, জুনে পাকে। জুন-জুলাইয়ের এ সময় বাজারে পাওয়া যায় পাকা জাম। দেখে লোভ সামলানো দায় হয়ে পড়ে। টসটসে রসালো এ ফল দেখে জিবে জল আসাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ফলটির উপকারিতা কী? ইচ্ছে হলে কি একসঙ্গে অনেক জাম খাওয়া উচিত? জেনে নিন...

জাম

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের শুরুতেই পাওয়া যায় জম্বুফলের নাম। সংস্কৃত নাম বলে 'জম্বুফল' নামটা আমাদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। কিন্তু জম্বু না বলে যদি জাম বল হয়, তাহলে সেই ফলকে চেনে না এমন মানুষ পাওয়া অসম্ভব। জামকে কালোজাম বলেও ডাকা হয়। সে জন্য অনেক সময় আমরা জামের ইংরেজি নামকে ব্ল্যাকবেরি বলে গুলিয়ে ফেলি। এ নামে আরেকটি ফল আছে, সেটি এ দেশে হয় না। কিন্তু জামের নামটা ইন্ডিয়ান ব্ল্যাকবেরি বললে বোধ হয় মেনে নেওয়া যায়। জামের ইংরেজি নাম জাম্বোলান, জাভা প্লাম, ব্ল্যাক প্লাম, জামুন ইত্যাদি। মির্টেসি পরিবারের এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Syzygium cumini। জামের জন্ম এ অঞ্চলে বলে এখানে ভুতিজাম, পাতিজাম, কাকজাম, বুটিজাম, ক্ষুদিজাম, পানিজাম, লোহাজাম ইত্যাদি নামের অনেক রকমের জাম দেখা যায়। এগুলো গ্রামের বনজঙ্গলে এমনিতেই জন্মায়।

পেকে শাঁস নরম হলে ফলের রং হয়ে যায় কালো, তখনই এর নাম ‘কালোজাম’ সার্থক হয়

জাম বড় বৃক্ষ, বাঁচে শত বছরের ওপরে। আর উচ্চতায় এক শ ফুটের বেশি হয়। জামের ফুল ফোটে মার্চ-এপ্রিলে। ফুল খুব ছোট ও সুগন্ধযুক্ত। ফুলের ব্যাস মাত্র পাঁচ মিলিমিটার। মে-জুন মাসে ফল হয়, জুনে পাকে। মে থেকে জুন—এই দুই মাস যদি ফলটা রোজ দেখা যায়, তাহলে এর রংবদল দেখে বিস্মিত হতে হয়। ছোট্ট জামের ফলদানা থেকে জালের কাঠির মতো হালকা সবুজ রঙের কাঁচা ফল। কাঁচা ফল পরিপুষ্ট হওয়ার পর যখন তার আকার আর বাড়ে না, তখন তার গায়ে লালচে আভার রং ধরে। রংটা শুরু হয় বোঁটার দিক থেকে। এরপর রংটা গোলাপি হয়ে পুরো ফলের গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। তখন জামকে গোলাপি মনে হয়। এরপর সেটা হয়ে যায় রক্তলাল বা মেরুন রং। পেকে শাঁস নরম হলে রংটা হয়ে যায় কালো, তখনই এর নাম ‘কালোজাম’ সার্থক হয়। ফলের খোসা কালো হলেও ভেতরে পাকা শাঁসের রং হয় সাদা। আবার সেই পাকা জাম খেলে মুখের লালার সঙ্গে রস বিক্রিয়া করে হয়ে যায় বেগুনি, যাকে আমরা বলি জাম রং, কবি জসীমউদ্‌দীন বলেছেন, ‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’

আরও পড়ুন

জাম ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে অবিশ্বাস্যভাবে কাজ করে, বিশেষ করে যাঁরা হাইপারগ্লাইসেমিয়ায় ভুগছেন। জামের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশ কম। এ কারণে তা রক্তে চিনির পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। অনেক গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন, জামের রস খাওয়ার পর মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই রক্তের সুগার লেভেল বা চিনির মাত্রা কমে যায়। আর জাম বিচির ক্ষেত্রে কমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। কয়েক সপ্তাহ জামরস খেলে ইনসুলিন গ্রহণকারীদের ইনসুলিন গ্রহণ কমাতে তা সাহায্য করে।

জামে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। তাই জামের রস রক্তশোধক হিসেবে কাজ করে এবং রক্তাল্পতা দূর করে। জামের রসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি থাকায় তা চোখ ও ত্বক ভালো রাখে। ভিটামিন সি থাকায় জাম খেলে মুখ ও গলার ক্ষত সেরে যায়। জাম খেলে বাড়ে ত্বকের মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা। জামে রয়েছে অক্সালিক অ্যাসিড ও গ্যালিক অ্যাসিডের মতো বেশ কিছু রাসায়নিক যৌগ। এ কারণেই জাম ম্যালেরিয়া ও বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া জীবাণুর সংক্রমণের বিরুদ্ধে দেহে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে।

জামে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। তাই জামের রস রক্তশোধক হিসেবে কাজ করে এবং রক্তাল্পতা দূর করে। জামের রসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি থাকায় তা চোখ ও ত্বক ভালো রাখে। ভিটামিন সি থাকায় জাম খেলে মুখ ও গলার ক্ষত সেরে যায়
আরও পড়ুন

তাই বলে জাম পেলেই যে গপাগপ করে অনেকগুলো একবারে খেতে হবে, তা নয়। বেশি খেলে পেট ফাঁপতে পারে, অজীর্ণ হতে পারে। পাকা ফল কিছু বেশি খেলে অসুবিধা তেমন হয় না, কিন্তু পাকা ফলের রস গ্লাস ভরে খাওয়া যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, একবার ১০ থেকে ২০ মিলিলিটারের বেশি পাকা জামের রস না খাওয়া উচিত। তেমনি জামের গুঁড়া ডায়াবেটিসের ওষুধ হিসেবে খেলে তা দিনে ১ থেকে ৩ গ্রাম, মানে আধা চা-চামচের বেশি খাওয়া ঠিক নয়।

জাম শুধু মানুষের জন্যই উপকারী নয়, অনেক প্রাণীর রোগও ভালো করে। বিশেষ করে মহিষ ও ছাগলের ভাইরাসজনিত বসন্ত বা পক্স রোগের ওপর জামের কার্যকারিতা গবেষণা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেছে, জামপাতা ব্যবহার করে ৯৮ দশমিক ৫২ শতাংশ ভাইরাস জীবাণু প্রতিরোধ করা যায়। জামের বিচির গ্যাস্ট্রো-প্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্য থাকায় তা আন্ত্রিক বা পেপটিক আলসার নিরাময়ে কার্যকর। এটা মিউকোসল ডিফেন্সিভ ক্রিয়া ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং লিপিড প্যারাঅক্সিডেশন কমায়।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

* লেখাটি ২০১৯ সালের মে সংখ্যায় প্রকাশিত