সাহসী রামগাংরা পাখি

মধ্যমাঠে বয়সী একটি বরইগাছ। সাতসকালে গাছটিতে পোকামাকড়খেকো ছোট ছোট পাখির ভিড় জমে গেছে। ডাকাডাকি-কোলাহল। লম্ফঝম্ফ। টুনটুনি, মৌটুসি, চশমাটুনি, ফটিকজল, নীলটুনি, বুলবুলিসহ কাঠশালিক, দোয়েল, ঝুঁটিশালিকও আছে। বরইগাছটিতে যেন পাখিদের উত্সব লেগে গেছে।

তিরবেগে সাদা-কালো রঙের চড়ুই আকৃতির একটি পাখি উড়ে এসে ঝট করে বসে বরইগাছটির মগডালে। জোরালো কণ্ঠে ডেকে যেন ধমক–ধামক দেয়, ‘টি-টিট্, টিট্ টিস্, সি-সিট্, সিট্ সিট্’। ‘চুপ চুপ, সব চুপ’ শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাবে অনায়াসে। ডাক শেষ করেই পাখিটি শূন্যে ছিটকে ওঠে। বরইগাছটির মাথার ওপরে দু-তিনটি পাক খেয়েই নিচের দিকে ডাইভ মারে। পরমুহূর্তেই ঊর্ধ্বমুখী উড়ালে গিয়ে আক্রমণ করতে চায় একটি বুলবুলিকে। বুলবুলিটি ছিটকে গিয়ে বসে অন্য ডালে। শরীর ফুলিয়ে আর পাখা দুলিয়ে পাখিটি অন্যদেরও ভয় দেখানোর প্রয়াস পায়। রাজকীয় দাপটে এ ডাল-ও ডাল করে এবার পাখিটি পোকা খেতে শুরু করে।

এতক্ষণ অন্য পাখিরা হুড়োহুড়ি-লুটোপুটি করে পোকা খাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছিল। এই পাখি আসায় তাতে একটু ভাটা পড়ল যেন। গাছের সব পাখিই পাখিটিকে সমীহ করে চলছে। পাখিটি খেতে খেতেই ধমক-ধামক ও দাপট দেখিয়ে চলেছে। সুন্দর এই পাখি সার্কাসম্যানের মতো সরু সরু ডালে ঝুলছে-দুলছে, ডিগবাজি দেওয়ার কায়দায় এক ডাল ছেড়ে অন্য ডালে গিয়ে ঝুলে পড়ছে। অতিচঞ্চল ও সাহসী পাখিটি দেখাচ্ছে অ্যাক্রোবেটিক শো–ও। পা দুখানা লম্বা লম্বা পদক্ষেপে এগিয়ে নিচ্ছে, কাত-চিত হচ্ছে অবলীলায়। একটি ঝুঁটিশালিকের দিকে তেড়ে যেতেই শালিকটি রুখে দাঁড়ায়, কেননা ওটার ঠোঁটে ধরা একটি মাকড়সার ডিমভরা থলে। পাখিটি চরম সাহসে ডান পাখানা হাতের মতো বাড়িয়ে দেয় শালিকের দিকে। শালিকের মুখ থেকে মাকড়সার ডিমভরা থলেটা ডাকাতের মতো ছিনিয়ে এনে মুখে পোরে গাপুস করে। শালিকটির মুখ তখন দেখার মতো! পাখিটি মারকুটে স্বভাবের। মাস্তানি ফলাতে ও গোলমাল পাকাতে ভালোবাসে।

রামগাংরা পাখি

এটি দেখতে খুবই সুন্দর। চিবুক, মাথার নিচের ঘাড়ের ওপর ও বুক কার্পাস তুলার মতো সাদা। পিঠ ঘন ধূসর। পিঠের নিচের পালকগুলোর কালো ও ধূসর রঙের টানের কম্বিনেশন চমত্কার। লেজের উপরিভাগ ধূসর। মাথা ও গলা কুচকুচে কালো, গলার কালোটা নেমেছে বুকের মধ্যিখান অবধি। দেখে মনে হয়, পাখিটি মাথায় পরেছে কালো রঙের ‘মাঙ্কি ক্যাপ’। পা ও ঠোঁট কালো। প্রায় সর্বক্ষণ ডাকাডাকি করা দুরন্ত স্বভাবের পাখিটির নাম রাজা চড়ুই, গাইছো চড়ুই, সাদা চড়ুই (যদিও চড়ুই এরা নয়)। ব্যাপক পরিচিত এরা রামগাংরা ও তিতপোখ নামে। ইংরেজি নাম Great tit, বৈজ্ঞানিক নাম Parus major। দৈর্ঘ্য ১৩ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩ গ্রাম।

রামগাংরার প্রধান খাবার নানা রকম পোকামাকড়। ফলও খায়। ফুল-ফলের কচি কুঁড়ি এদের খুবই প্রিয়। পাকা পেঁপে খেতে খেতে এরা অনেক সময় পেঁপের ভেতরেই ঢুকে পড়ে। সে বড় মজার দৃশ্য। সুযোগ পেলে তাল-খেজুরের রসও পান করে।

রামগাংরা পাখি

বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম এদের বসন্তকাল থেকে বর্ষা ঋতু শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত। সুপারি-নারকেল ও অন্যান্য গাছের খোঁড়লে বাসা বাঁধে স্বামী-স্ত্রী মিলে। উপকরণের মধ্যে শুকনা সুপারির খোসা, নারকেলের সুতার মতো ছোবড়া, শিকড়-লতা-ঘাসই প্রধান। এরা এমন খোঁড়লে বাসা বাঁধতে পারে, যে খোঁড়লের তলদেশ হয়তো ৬-৮ ফুট তলায়। বোকা(?) পাখিরা প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকে বেয়ে বেয়ে নিচের বাসায় নামে, উঠেও আসে একই কায়দায়। এ রকম বাসা আমি দেখেছি বার কয়েক।

ডিম পাড়ে তিন থেকে সাতটি। দুজনই ডিমে তা দেয় পালা করে। ডিম ফুটে ছানা হয় ১২ থেকে ১৪ দিনে। ৬ থেকে ৮ ফুট (এটি ব্যতিক্রমী) গভীরে ছানারা যখন বোঝে ওড়ার সময় হয়ে গেছে, তখন দুই পা দিয়ে বেয়ে বেয়ে প্রবেশমুখে উঠেই উড়াল দেয় (আমি নিজে দেখেছি)।

এই পাখিদের দেখতে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সব জায়গায়। বড় বড় শহর, নগর ও বন্দরেও দেখা মিলবে।

লেখক: পাখিবিশারদ

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান