১০ কোটি বছরের ঘুম

১০ কোটি বছরের পুরোনো কাদামাটি থেকে উঠে আসা

তখনো ক্রিটেশাস যুগ শেষ হয়নি। পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে ট্রাইসেরেটপস, আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে অর্নিথোকেরাস। ভারতবর্ষ জড়িয়ে আছে মাদাগাস্কার দ্বীপকে। কেবল আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া। স্থৈর্য নিয়েও ক্রমাগত ভেসে যাচ্ছে দূরে।

এমন এক সময় অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমে, সাগরের গভীর থেকে গভীরে ডুবে যাচ্ছিল কয়েকটা ব্যাকটেরিয়া। হয়তো ডুবে যাচ্ছিল বলাটা অন্যায়ই হবে, কেননা, তাদের কাছে জল আর স্থলের পার্থক্য খুব বেশি নয়। হয়তো স্রেফ ইচ্ছার বশে তারা নিচে নামছিল—হাজার হাজার মিটার ধরে—যেখানে সমুদ্র শীতল, চারপাশে নিরেট অন্ধকার। কালেভদ্রে দু-একটা প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাদের প্রায় কেউই চোখে দেখে না। যে অঞ্চলে আলোর দেখা নেই, সেখানে চোখ নিয়ে বিচরণ করাটা অর্থহীন।

সেই অতল সমুদ্রে, ছয় হাজার মিটার ডুবে কয়েকটা ব্যাকটেরিয়া যখন নরম ভূমির স্পর্শ পেল, তারা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সুগভীর ঘুম। সেই ঘুমের মধ্যে পৃথিবী থেকে ডায়নোসর উধাও হল, ইউরেশিয়া-ভারতবর্ষের সংঘর্ষে হিমালয় মাথা তুলে দাঁড়াল, শিম্পাঞ্জি ও আদি মানুষ পৃথিবীতে প্রথম পা ফেলল, এমনকি মাথার ওপর দিয়ে ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলানের জাহাজও পাল তুলে চলে গেল, তাদের ঘুম ভাঙল না। ১০ কোটি বছর তারা এভাবে ঘুমাল।

এরপর একদিন, জাপান সমুদ্রভূমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংস্থার ভূ-অণুজীববিদ ইয়ুকি মরোনো তাঁর দল নিয়ে সেই গভীরে প্রবেশ করলেন। তত দিনে সেই ব্যাকটেরিয়াদের ওপর মাটি জমেছে স্তরের পর স্তরে। সেই মাটির ওপর বিরাজ করছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ঘূর্ণি, সমুদ্রের মৃততম অঞ্চল হিসেবে যেটা পরিচিত। জীবনের জন্য ন্যূনতম যেসব পুষ্টি উপাদান থাকা প্রয়োজন, তার প্রায় কিছুই সেখানে নেই। এবং এ কারণেই অঞ্চলটা মরোনোর আগ্রহের কেন্দ্র। তিনি খুঁজে বেড়ান—এমন প্রাণহীন সমুদ্রের ভেতর আদৌ প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায় কি না।

ফলে একদিন মরোনোর গবেষণা দল সেই ছয় হাজার মিটার গভীর সমুদ্রতলে গভীর ফুটো করে। ওপরের মাটি সরিয়ে ভেতরের কাদামাটিটুকু তুলে আনে। ১০ কোটি বছরের পুরোনো সেই কাদামাটি। এবং তারা আবিষ্কার করে, সেই মাটিতে সামান্য, খুব সামান্য অক্সিজেনের অস্তিত্ব আছে। আর অক্সিজেন যেহেতু আছে, প্রাণ থাকার সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তাই মরোনো খুব সাবধানে সেই কাদামাটিটুকু একটা কাচের বোতলে জড়ো করলেন। ব্যাকটেরিয়াদের উপযুক্ত দানাপানি দিলেন সেখানে। একটু বিশেষ ধরনের দানাপানি, খটমটে ভাষায় বললে সেই খাবারে কার্বন আর নাইট্রোজেনের আইসোটোপ আছে। যদি কাদামাটিতে ব্যাকটেরিয়া থাকেই, তারা সেই খাবার খেতে বাধ্য। খেলে প্রথমত তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটবে। অন্যদিকে খাবারটা বিশেষ ধরনের হওয়ার কারণে বাইরে থেকে বোঝা যাবে, ব্যাকটেরিয়া খেয়েছে কি না।

কাচের বোতলে খাবার দিয়ে মরোনোও দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকলেন। ১০ কোটি বছর নয় অবশ্যই, মোটে ৫৫৭ দিন।

এরপর যেদিন সেই বোতল খুলে মরোনো একটুখানি কাদামাটি বের করলেন, তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল, সেই আদিম কাদায় লাখ লাখ ব্যাকটেরিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে! অন্তত আট ধরনের ভিন্ন ভিন্ন অণুজীব। এদের অনেকের সঙ্গেই মানুষ পরিচিত, অগভীর সমুদ্রে প্রায়ই এদের পাওয়া যায়। তাই বলে নিষ্প্রাণ সমুদ্রে ১০ কোটি বছরের পুরোনো মাটিতে পাওয়া যাবে, ব্যাপারটা অকল্পনীয়!

এই সুদীর্ঘকাল ধরে ব্যাকটেরিয়ারা কী করেছে, বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না। যে মাটিতে তারা ছিল, সেখানে খাদ্য বলতে যেহেতু কিছুই নেই, তাদের পক্ষে সংখ্যাবৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, তারা শক্তি সঞ্চয় করার জন্য স্রেফ ঘুমিয়ে ছিল। ডায়নোসর যুগের যে ব্যাকটেরিয়াটা একদিন ডুবে গিয়েছিল, সে-ই উঠে এসেছে মরোনোর হাতে, আক্ষরিক অর্থেই তার বয়স ১০ কোটি বছর!

বিষাক্ত বা উত্তপ্ত জায়গাতে যে ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকতে পারে, সেটা আগেই জানা ছিল। এখন জানা গেল, খাদ্যশূন্য স্থানেও অবিশ্বাস্য সময় ধরে তারা বেঁচে থাকে। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে যেখানে জীবনধারণ অসম্ভব মনে হচ্ছে, সেখানেও প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং অন্য গ্রহে, অন্য কোনোখানে, যে অঞ্চল দৃশ্যত মৃত, তার গভীরে প্রাণের সন্ধান পেলে সেটা বড়জোর বিষম খাওয়ার মতো ঘটনা হতে পারে, জ্ঞান হারানোর মতো নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ইয়ুকি মরোনো, নেচার কমিউনিকেশন্স (২৮ জুলাই, ২০২০); এলিজাবেথ পেনিসি, সায়েন্স ম্যাগাজিন