ঘরে বসে বিজ্ঞান গবেষণা?

পয়সার অভাব আসলেই আছে বটে, কিন্তু সেটাই সব নয়; বরং দামি সাজসরঞ্জাম আর উন্নত ল্যাব ছাড়াও দেশে উঁচুমানের জীববিজ্ঞান গবেষণা করা সম্ভব। বিশেষ করে দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের অনেকে সেটা করছেনও।

এক

২০১৯ সালের শেষ দিকে আমার জীবনে দুটো ঘটনা ঘটে। এক, বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ মহামারীর সূচনা হয়। আর দুই, জীববিজ্ঞানে পিএইচডি করার উদ্দেশ্যে আমি বাংলাদেশের মায়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্লেনে উঠি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষের পর দেশে আমার বেশ কিছুদিন গবেষণার সুযোগ হয়েছিল। সে সময় যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করতেন, ‘আচ্ছা, বাংলাদেশে জীববিজ্ঞান গবেষণা হয় বটে, কিন্তু অত যে দুনিয়া-কাঁপানো গবেষণা হয়, তা কিন্তু নয়। এর কারণ কী? কেন আমরা জীববিজ্ঞান গবেষণায় উন্নত দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিতে পারছি না?’ তার উত্তরে হয়তো আমি বলতাম, ‘এর কারণ হচ্ছে পয়সা। জীববিজ্ঞান গবেষণা এমনিতেই একটু পয়সাপাতির ব্যাপার। এর জন্য ল্যাব লাগে, যন্ত্রপাতি লাগে, দামি বিকারক আর রাসায়নিক সাজসরঞ্জাম লাগে। গবেষণার তেল-নুন দেশে পৌঁছতেও মাসখানেক পেরিয়ে যায়। জিনিসগুলো গাছে ধরে না, এদের আনতে হয় অনেক কষ্ট করে, বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীর বড় বড় অনুদান সংস্থা একটা উন্নত দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যত সহজে টাকা দেন, বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তারা সে পর্যায়ের ভরসা পান না।’

আমার মনে হয়, এ উত্তরটা আমার একার নয়। বাংলাদেশে জীববিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে জড়িত অনেকেই এর কাছাকাছি উত্তর দেবেন। কিন্তু আজ, মানে পিএইচডির তিন বছর পেরোনোর পর আমার উত্তর খানিকটা ভিন্ন হবে। পয়সার অভাব আসলেই আছে বটে, কিন্তু সেটাই সব নয়; বরং দামি সাজসরঞ্জাম আর উন্নত ল্যাব ছাড়াও দেশে উঁচুমানের জীববিজ্ঞান গবেষণা করা সম্ভব। বিশেষ করে দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের অনেকে সেটা করছেনও।

আমার মতের এই পরিবর্তনটুকু ব্যাখ্যা করার জন্য আমার পিএইচডি অভিজ্ঞতা নিয়ে দুকথা বলতে হবে।

১৯-এর শেষে মহামারী আসার ফলে ল্যাব-ট্যাব তো বটেই, পুরো ক্যাম্পাস বিল্ডিংগুলোতেই তালা পড়ে যায়

আমি জীববিজ্ঞান গবেষক। আমার গবেষণার জায়গা হলো ল্যাব। অথচ ১৯-এর শেষে মহামারীটা আসার ফলে ল্যাব-ট্যাব তো বটেই, পুরো ক্যাম্পাস বিল্ডিংগুলোতেই তালা পড়ে গেল। মাসের পর মাস ধরে আমরা বাসায় আটকে রইলাম। এভাবে যার যাই চলুক, জীববিজ্ঞানের পিএইচডি তো আর চলে না। প্রফেসর বুদ্ধি দিলেন, ল্যাবের কথা আপাতত ভুলে যাও। প্রোগ্রামিং শেখ, ঘরে বসেই কম্পিউটারে জীববিজ্ঞান গবেষণা শুরু করো। তার কথা মতো তাই করেই মহামারীর প্রথম দুবছর কাটিয়ে দিলাম। ল্যাবের ত্রিসীমানায় না গিয়ে বাসায় কম্পিউটারের সামনে বসে দিয়ে জীববিজ্ঞান গবেষণা কীভাবে সম্ভব, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। আপাতত এটুকু বলে রাখি, সেই ল্যাপটপজাত গবেষণা নিয়েই এর মধ্যে আমি—এবং আমার মতো আরও অজস্র জীববিজ্ঞান গবেষক—সহকর্মীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করি, বিজ্ঞান কনফারেন্সে কথা বলি, গবেষণার ফলাফল লিখে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে জমা দিই। 

আমার এই অভিজ্ঞতার পুরোটা সময় কেবল একটা কথা বারবার মনে হয়েছে। সেটা হলো, এ গবেষণা করার জন্য তো আজ আমার ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে আসার দরকার ছিল না। কারণ, এই কাজের ভিত্তি হচ্ছে প্রোগ্রামিং। যুক্তরাষ্ট্রের দামি ল্যাবের হাজারো সাজসরঞ্জাম আর রাসায়নিক মেখে তো এটি হয়নি। হয়েছে কম্পিউটারে। কম্পিউটার তো দেশেই ছিল। আমি তো তাহলে এই গবেষণা দেশে বসেই করতে পারতাম।

জীববিজ্ঞান গবেষণা—মানে বেশ উঁচুমানের, হাই-ইমপ্যাক্ট গবেষণা যে দেশে বসেও সম্ভব, সেটা এর আগে অন্যদের কাছে শুনেছি বটে, কিন্তু নিজের গবেষণার অভিজ্ঞতা দিয়ে এর হাতেকলমে প্রমাণ মিলল।

কিন্তু আমার কথা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ যদি আসলেই স্রেফ একটা কম্পিউটার মিললেই দারুণভাবে জীববিজ্ঞান গবেষণা চালিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে দেশে থাকতে আমি সেটা করতে পারলাম না কেন? শুধু আমি নই, দেশে আমার মতো আরও বহু জীববিজ্ঞান শিক্ষার্থী বা গবেষক এই চমৎকার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারছেন না কেন? দেশের গবেষণার জন্য এটা কি রীতিমত একটা ধন্বন্তরি ব্যাপার নয়?

সে ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলব, কিন্তু আগে এই ঘরে বসে জীববিজ্ঞান গবেষণাটা যে আসলে কী বস্তু, তা একটু খোলাসা হওয়া জরুরি।

তাবৎ মহাবিশ্বের যে অংশগুলো সবচেয়ে জটিল, এতই জটিল যে তারা নিজেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে, সে অংশগুলোর নাম আমরা দিয়েছি জীব। তাদের নিয়ে বিজ্ঞানটাই জীববিজ্ঞান।

দুই

জীববিজ্ঞান পৃথিবীর জটিলতম শাস্ত্রগুলোর একটি। এটা নেহায়েত মার্কেটিংয়ের কথা নয়, বা নিজে জীববিজ্ঞানের লোক বলে বলছি না, একেবারেই সাদা সত্য কথা। তাবৎ মহাবিশ্বের যে অংশগুলো সবচেয়ে জটিল, এতই জটিল যে তারা নিজেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে, সে অংশগুলোর নাম আমরা দিয়েছি জীব। তাদের নিয়ে বিজ্ঞানটাই জীববিজ্ঞান।

এমনিতে খোলা চোখে জীবজগৎকে দেখলে এর প্রতি অতটা শ্রদ্ধা নাও জাগতে পারে, কিন্তু কোষের ভেতরের জগৎটায় একবার ঢুকলে তাক না লেগে উপায় নেই। আমাদের প্রায় প্রত্যেকটা কোষের ভেতরেই ধুন্ধুমার কর্মযজ্ঞ—ডিএনএর প্রতিলিপি বানানো, শক্তি উৎপাদন, চলাচল, বর্জ্য পদার্থের রিসাইক্লিং জাতীয় হাজারটা ব্যাপার ছাড়াও দেহের একেক জায়গার কোষের একেকরকম বিশেষায়িত কাজ থাকে। কেউ ঝাড়ুদারের মতো ময়লা সরায়, কেউ দেহে জীবাণু-টিবাণু দেখলে হামলা করে, কেউ দুপদুপ করে একসঙ্গে নেচে রক্ত সঞ্চালন করে, কেউ রাসায়নিক দিয়ে খাবার গলিয়ে হজমের ব্যবস্থা করে। গেল শ-খানেক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কোষের নাড়িভুঁড়ি অনেকটা হাতিয়ে দেখেছেন বটে, কিন্তু এর ভেতরের কোটিরকম খেলোয়াড়ের অযুত-নিযুত মিথস্ক্রিয়া ভালোভাবে বুঝতে হয়তো আমাদের আরও শ-খানেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

এই অনন্ত গবেষণাযাত্রায় সম্প্রতি, মানে এই গেল দু-দশকের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। সেটা হলো, বিজ্ঞানীরা কোষের ভেতরে যতরকম অণু থাকে, বিশেষ করে ডিএনএ, আরএনএ ও প্রোটিন, তাদের ‘পড়তে’ শিখে গেছেন। এই অণুগুলোর গায়েই জীবদেহের যাবতীয় বিবরণ ‘লেখা’ থাকে। যতই দিন যাচ্ছে, এই ‘অণু পড়া’র ব্যাপারটা ততই সহজ, সস্তা আর সহজলভ্য হয়ে উঠছে। এর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা মানুষ তো বটেই, অন্ত্রের জীবাণু আর সর্দির ভাইরাস থেকে শুরু করে হাতি, ঘোড়া, তিমি, পোকামাকড়, এমনকি বিলুপ্ত জীবের ডিএনএর তথ্য পর্যন্ত বের করে এনেছেন। কষ্টার্জিত সেই তথ্য-উপাত্ত জমা হচ্ছে অতিকায় সব ডেটাবেজে। এটা সত্যিকার অর্থেই একটা বৈশ্বিক বিপ্লব—পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের বিজ্ঞানী এই বিশাল কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। আমাদের দেশেই এরকম ঘটনা আমরা দেখেছি ডক্টর মাকসুদুল আলম স্যারের পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রকল্পের মধ্য দিয়ে। পেপার-পত্রিকায় ব্যাপারটাকে যে কাব্য করে বলা হয়েছে ‘পাটের জীবন রহস্য উদঘাটন’—সেটা বাস্তবতা থেকে অতটা দূরে নয়। যেহেতু জীবদেহের গঠন আর কার্যকারণ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য কোষের ভেতরের এই অণুগুলোতেই লেখা থাকে, কাজেই পাটের সম্পূর্ণ ডিএনএ ‘পড়ে’ ফেলার পর যদি আমরা এর জীবন রহস্য উদঘাটন হয়ে গেছে দাবি করি, অতটা অতিরঞ্জন হবে না।

তবে ব্যাপারটার মধ্যে বিশাল বড় একটা ‘কিন্তু’ আছে। বিজ্ঞানীরা কোষের ভেতরের ডিএনএ-আরএনএ-প্রোটিনের বর্ণমালা বেশ তড়তড়িয়ে পড়তে শিখেছেন বটে, কিন্তু কোষের ভেতর কার কাজ কীরকম, কে কোন প্রেক্ষিতে কীরকম আচরণ বা মিথস্ক্রিয়া করে, আর সবার সম্মিলিত খাটুনিতে পুরো কোষের পরিবেশটা কীভাবে গড়ে ওঠে—এ ব্যাপারে আমাদের জানায় এখনো অনেক ফাঁক রয়ে গেছে।

এজন্য বিজ্ঞানীরা কোষের জগত থেকে যে উপাত্তগুলো বের করে তাদের ডেটাবেজ বোঝাই করছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা এদের পূর্ণ মাজেজা ধরতেই পারেননি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম—বিজ্ঞানীরা যেন কোনো এক ভিনগ্রহের লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছেন। আর ঢুকে ভেতরের বইপত্র বুঝে না বুঝে একধার থেকে ফটোকপি করা শুরু করেছেন। যতই দিন যাচ্ছে, ভিনগ্রহের ভিনভাষার সেই তাকভর্তি দস্তাবেজের ফটোকপি বেড়েই চলেছে; কিন্তু এখনো এর মানে উদঘাটন করতে বিজ্ঞানীদের বহুদূর রয়ে গেছে। হয়তো আমরা মোটামুটি আঁচ করতে পারি কোন বইটা প্রেমের, কোনটা রান্নার আর কোনটা রাজনীতির; কিন্তু এই অসংখ্যরকম বর্ণনা একত্রিত হয়ে ভিনগ্রহী সমাজ-সংস্কৃতির সম্পূর্ণ চেহারা কীরকম দাঁড়ায়, তা নিয়ে অতটা জানিনি। সেখানেই এখন দুদ্দাড় বেগে গবেষণা চলছে।

বিজ্ঞানীরা কোষের ভেতরে যতরকম অণু থাকে, বিশেষ করে ডিএনএ, আরএনএ ও প্রোটিন, তাদের ‘পড়তে’ শিখে গেছেন।

সেই গবেষণার একটা বিশাল অংশ ঘটে কম্পিউটারে। ডেটাবেজের ডিএনএ-টিএনএর মাইলকে মাইল তথ্য হিসেব করা মানুষের কম্ম নয়, তার জন্য দরকার যন্ত্র। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং হচ্ছে সেই শাস্ত্র, যার মাধ্যমে আমরা যন্ত্রকে দিয়ে আমাদের নিজেদের হিসেবের কাজগুলো করিয়ে নিতে পারি। একইভাবে, একটুকরো তথ্যের সঙ্গে আরেক তথ্যের সম্পর্ক, প্রভাব, বিস্তার ইত্যাদি বোঝার জন্য আমাদের আরেকটা চিরাচরিত অস্ত্র আছে, তার নাম পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যান আর প্রোগ্রামিং-এর দ্বৈত ছুরিকাঁচি ডেটাবেজে জমা তথ্যের ওপর ব্যবহার করার ফলে যে জীববিজ্ঞানটুকু হয়, তাকেই আমরা বলি কম্পিউটেশনাল বায়োলজি। যেহেতু তথ্য আগেই তুলে ডেটাবেজে রেখে দেওয়া হয়েছে, কাজেই এর জন্য আমাদের ল্যাবের ছায়াও মাড়াতে হয় না, একটা কম্পিউটার থাকলেই হয়। এখানে উল্লেখ্য, কম্পিউটেশনাল বায়োলজির লাগোয়া আরেকটা শাস্ত্রের নাম বায়োইনফর্মেটিকস। যার লক্ষ্য জীববিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য সফটওয়্যার তৈরি। সত্যি বলতে, দেশের অনেকেই কম্পিউটেশনাল বায়োলজি বোঝাতে ‘বায়োইনফর্মেটিকস’ কথাটা ব্যবহার করেন। এ লেখায় ‘কম্পিউটেশনাল বায়োলজি’ শব্দটাই ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই শাস্ত্রের সঙ্গে মহাকাশবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যার খানিক মিল আছে। মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাজের একটা বিশাল অংশ হচ্ছে অত্যাধুনিক সব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে দূর আকাশের ছবি তোলা। কিন্তু সেই ছবির স্তূপ হাতড়ে তারাদের গঠন-জীবন-অবস্থান-প্রকৃতি ইত্যাদি বের করতে হলে চাই কম্পিউটার ও পরিসংখ্যান। জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। বিজ্ঞানীরা কোষের ভেতর অত্যাধুনিক ক্যামেরা দিয়ে অসংখ্য ছবি তুলে ডেটাবেজ ভরিয়েছেন এবং ভরাচ্ছেন। বাকি বিজ্ঞানটা করতে হলে কম্পিউটার দিয়ে এই ছবিগুলোর ভাংচুর করতে হবে।

এইসব ডেটাবেজে স্তূপীকৃত সব উপাত্তের মধ্যেই রয়েছে আমাদের সত্যিকার জীবন রহস্য। এর মধ্যেই আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে নানা রোগের জেনেটিক ভিত্তি, গাছের ফলন বাড়ানোর উপায়, আছে ক্যান্সারের আরোগ্য, সামনের আরেকটা প্যান্ডেমিক ঠেকানোর চাবি। এসব ডেটাবেজ পুঁজি করেই পৃথিবীতে অজস্র বিজ্ঞানী দুনিয়া-কাঁপানো গবেষণা করে চলেছেন। সোয়ান্তে প্যাবো যে প্রাচীন মানুষের ডিএনএ আবিষ্কার করে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বসলেন, সেই কাজের অনিবার্য অংশ ছিল কম্পিউটার। কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি থেকে শুরু করে এটা কোথায় কোন দেশে কীরকম হারে ছড়াচ্ছে, কখন নতুন ভেরিয়েন্টের আবির্ভাব হচ্ছে, সেগুলো কতখানি ক্ষতিকর—জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এরকম হাজারটা গবেষণার জন্য অপরিহার্য হলো কম্পিউটার। এমনকি এখনকার দিনে যেকোনো নতুন ওষুধ ডিজাইন করতে গেলে গবেষকদের প্রথম অস্ত্রই হচ্ছে কম্পিউটার।

আজকের জীববিজ্ঞান গবেষণা ল্যাবে ঘটে বটে, কিন্তু একইসঙ্গে ঘটে গবেষকদের বাসাতেও।

বাংলাদেশের মতো দেশে জীববিজ্ঞান গবেষণার জন্য কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সম্ভাবনা এখানেই।পৃথিবী পাল্টে দেওয়ার মতো বিজ্ঞান দেশে বসে, দামি রাসায়নিক বা সাজসরঞ্জামের অপেক্ষায় না থেকেই করা সম্ভব।

তিন

বাংলাদেশের মতো দেশে জীববিজ্ঞান গবেষণার জন্য কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সম্ভাবনা এখানেই।পৃথিবী পাল্টে দেওয়ার মতো বিজ্ঞান দেশে বসে, দামি রাসায়নিক বা সাজসরঞ্জামের অপেক্ষায় না থেকেই করা সম্ভব। আমার এই লেখার বহু আগেই অনেকে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন এবং দেশে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি গবেষণা ও প্রশিক্ষণের প্রতি জোর দিয়েছেন। কিছুদিন আগে কম্পিউটার সায়েন্স র‍্যাঙ্কিং-এর এক ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, ২০২১-২২ সালে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি গবেষণার দিক থেকে বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ত্রয়োদশ স্থানে ছিল বাংলাদেশের বুয়েট। মানতেই হবে, বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষক—বিশেষ করে মোহাম্মদ সোহেল রহমান ও মো. সামসুজ্জোহা বায়েজিদ এই শাস্ত্রে বিশ্বমানের কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা ছাড়াও দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও কম্পিউটেশনাল বায়োলজি নিয়ে উৎসাহ ও গবেষণা বেশ কিছুদিন ধরেই বাড়ছে। জীববিজ্ঞান গবেষণাপ্রবন্ধের যে ডেটাবেজ সাইটগুলো আছে, সেগুলোতে চোখ বুলালেই এই শাস্ত্রে বছর বছর বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের ছাত্র ও গবেষকদের মধ্যে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি যতটা জনপ্রিয় হতে পারত, এখনও ততটা হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিজ্ঞানের এই শাস্ত্রে কাজ যত প্রকটভাবে ছড়িয়েছে, বাংলাদেশ এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। এর পেছনে অন্তত তিনটা কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রথম দুটো বোঝা বেশ সহজ, কিন্তু তৃতীয়টা খানিক ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।

প্রথম কারণ হলো, কম্পিউটেশনাল বায়োলজিকে সত্যিকার অর্থে জীববিজ্ঞানের অংশ হিসেবে দেখতে না পারা। আজ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের অনেকেই এই শাস্ত্রে জীববিজ্ঞানের চেয়ে কম্পিউটার সায়েন্সের গন্ধটাই বেশি পান। এর সঙ্গে আবার জড়িত আছে প্রোগ্রামিং-এর ভীতি এবং নতুন শাস্ত্র বিষয়ক অনিশ্চয়তা। এ ব্যাপারে আমাদের মনে রাখা উচিত, কম্পিউটেশনাল বায়োলজি হলো সেই শাস্ত্র, যেখানে কম্পিউটার ব্যবহার করে জীববিজ্ঞানের রহস্য সমাধান করা হয়। তার মানে, শাস্ত্রটার পদ্ধতি হয়তো কম্পিউটার, কিন্তু এর প্রশ্ন-তদন্ত ইত্যাদি সবই জীববিজ্ঞানকেন্দ্রিক। এজন্যই এ শাস্ত্রের বিজ্ঞানীরা সবসময় কম্পিউটেশনাল বায়োলজি শেখার আগে জীববিজ্ঞানের ভিত্তি মজবুত করার কথা বলেন।

তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই অন্তরায়টুকু আমরা দিনকে দিন অনেকাংশে কাটিয়ে উঠছি। এর একটা কারণ ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে প্রচুর কোর্স, প্রোগ্রাম এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন। সোশাল মিডিয়ার কারণে ইদানীং এই উদ্যোগগুলোর প্রচার  অনেক ব্যাপকতা পেয়েছে। এদের সহজলভ্যতার ফলেই জীববিজ্ঞানের ছাত্র ও গবেষকরা বুঝতে পারছেন, কম্পিউটেশনাল বায়োলজি আদতে একজাতের জীববিজ্ঞানই বটে। এটা শেখার জন্য কম্পিউটার সায়েন্সের খুব একটা গভীর জ্ঞান দরকার নেই। আর প্রোগ্রামিং-পরিসংখ্যানের যে অংশটুকু শেখা দরকার, তা খুব বেশি হলে মাসকয়েকের মধ্যেই আয়ত্ত করা সম্ভব।

এমনকি ঢাকার একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন গবেষক হিসেবে আমার সুপারকম্পিউটার সার্ভিসেরও ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় আমি এর ওপর কোনো গবেষণা করতে পারিনি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে আসার বছরখানেকের মধ্যেই আমি এ বিষয়ে বেশ খানিকটা অগ্রগতি করে ফেললাম। কেন তাহলে দেশে আগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সুবিধা থাকার পরেও এটা হয়ে উঠল না?

দ্বিতীয় কারণটা হলো কম্পিউটিং রিসোর্সের অভাব। যেমনটা বললাম, এই শাস্ত্রের জন্য জীববিজ্ঞানের দামি ল্যাবরেটরি, রাসায়নিক বা অন্যান্য সরঞ্জাম দরকার হয় না বটে, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই দরকার হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার। সুখের বিষয়, এখন বাংলাদেশের অনেকগুলো শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানেই সুপারকম্পিউটার সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই সেবা দেয়। কাজেই, গবেষণার প্রয়োজনে যে কেউ তাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটার থেকেই লগ ইন করে সুপারকম্পিউটারের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাটুকু হলো জ্ঞান বা সচেতনতা। এ ধরনের চমৎকার সুযোগের ব্যাপারে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা গবেষকেরা অতটা জানেন কি না, সেটা।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় এই দুটো সুযোগই আমার ছিল। কম্পিউটেশনাল বায়োলজি যে শাস্ত্র হিসেবে খুবই সম্ভাবনাময়, তা আমি জানতাম। এতে আমার যথেষ্ট আগ্রহও ছিল। সেই আগ্রহের বশবর্তী হয়ে আমি প্রোগ্রামিং-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশ কয়টা কোর্স করেছিলাম। এমনকি ঢাকার একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন গবেষক হিসেবে আমার সুপারকম্পিউটার সার্ভিসেরও ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় আমি এর ওপর কোনো গবেষণা করতে পারিনি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে আসার বছরখানেকের মধ্যেই আমি এ বিষয়ে বেশ খানিকটা অগ্রগতি করে ফেললাম। কেন তাহলে দেশে আগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সুবিধা থাকার পরেও এটা হয়ে উঠল না?

এর কারণ এখন বুঝি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এই ‘কীভাবে করি’ জাতীয় প্রশ্নগুলো হলো কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সহজ অংশ। অন্যদিকে প্রফেসর বা সুপারভাইজারদের কাজই আসলে কঠিন—‘কী করতে হবে’ সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া।

চার

পিএইচডি ল্যাবে জয়েন করার কিছুদিনের মাথায় প্রফেসর বললেন, ব্রাজিলে নতুন একটা ভাইরাস পাওয়া গেছে। কম্পিউটারে সেটার ডিএনএ ঘেঁটে দেখ, এটা কি পরিচিত কোনো প্রোটিন বানায় কি না।

এই একটা বাক্যেই তার নির্দেশনা শেষ। আমি কম্পিউটেশনাল বায়োলজিতে তখন নিতান্তই বকলম—জীবনের অধিকাংশ সময় কম্পিউটারকে চিনেছি স্রেফ গেম খেলার বস্তু হিসেবে। প্রফেসর তাতে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। কোথাকার কোন ব্রাজিলের ডিএনএ কম্পিউটারে তালাশ করতে আমাকে লাগিয়ে দিলেন। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন সফটওয়ার ব্যবহার করতে হবে, কীসের ওপর কোর্স করতে হবে, কার কাছে যেতে হবে, এমনকি সুপারকম্পিউটার সার্ভিস ব্যবহার করার উপায় কী—এসব নিয়ে তিনি একটা কথাও বললেন না।

এর কারণ এখন বুঝি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এই ‘কীভাবে করি’ জাতীয় প্রশ্নগুলো হলো কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সহজ অংশ। অন্যদিকে প্রফেসর বা সুপারভাইজারদের কাজই আসলে কঠিন—‘কী করতে হবে’ সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। ঠিকই ওই কীভাবে করার ব্যাপারটা আমি নিজে ইন্টারনেট নাড়াচাড়া করে বা সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বের করে ফেললাম। এটা আমার একার অভিজ্ঞতা নয়, অন্য অনেকেই আমার কাছে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে একই ধরনের কথা বলেছেন। যদি ‘কী কাজ’ করতে হবে সে ব্যাপারে খানিকটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়, তাহলে ‘কীভাবে করতে হবে’ সেটা বের করা, মানে এরপর দরকারমাফিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যাপার শিখে নেওয়া অত বড় বিষয় নয়। আবার অন্যদিকে, এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা হয়তো দেশে বসে আমার মতো কম্পিউটেশনাল বায়োলজির ডজনখানেক কোর্স করে ফেলেছেন। হয়তো তাঁদের কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রিও আছে; কিন্তু এই দক্ষতা ব্যবহার করে কী কাজ করবেন বা কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন, সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় ওই ‘কীভাবে করি’র জ্ঞান ব্যবহার করে গবেষণা করতে পারছেন না।

দেশের নবীন গবেষকেরা এ বছর প্রথম বাংলাদেশে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি কনফারেন্স আয়োজন করেছেন, এটিই সেই কনফারেন্স

এটাই আমি মনে করি দেশে কম্পিউটেশনাল বায়োলজির বিস্তৃতির পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা। কী কাজ করতে হবে বা কোন গবেষণা প্রকল্প হাতে নিতে হবে, সে বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব। এটা মোকাবেলার জন্য বিশেষ করে দেশের জীববিজ্ঞান গবেষকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে—যাঁরা নিজেদের গবেষণাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা সমস্যা চিহ্নিত করবেন এবং ছাত্রদের সেই সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা দেবেন। বিশেষ করে সায়েন্টিফিক কনফারেন্স বা সিম্পোজিয়াম এর একটা চমৎকার মাধ্যম। এর ফলে দেশের অন্যান্য বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায় এবং নিজের সম্ভাব্য কাজেরও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গেল এক দশকে দেশের কম্পিউটেশনাল বায়োলজি গবেষণায় উত্তরোত্তর উন্নতির সূত্র ধরেই দেশের নবীন গবেষকেরা এ বছর প্রথম বাংলাদেশে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি কনফারেন্স আয়োজন করেছেন।

এই সবই আসলে বাংলাদেশে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি গবেষণার সম্ভাবনার কথা জানান দেয়। আপনি যদি জীববিজ্ঞানের লোক হয়ে থাকেন, তা ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক যাই হন না কেন, আর গবেষণার প্রতি যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে এই শাস্ত্রের দিকে তাকানোর এটাই মোক্ষম সময়। হয়তো আপনার-আমার-আমাদের উদ্যোগের হাত ধরেই আসছে দিনগুলোতে দেশের জীববিজ্ঞান গবেষণায় বিপ্লব ঘটে যাবে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, সেল অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র