প্রাণিজগৎ
চিলের সাহস ও শিকার-কৌশলের কথা
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
মুরগিটি তার দশটি তুলতুলে ছানা নিয়ে চরছিল উঠোনের একপাশে। ওই উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা যায় না—এমনই ঘন বুনট আম, বরই, সফেদা, পেয়ারা ও আতা গাছের ডালপালার। বয়সী একটা বরই গাছও ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো।
তবু একটি শিকারি পাখি ডানা মুড়ে ডাইভ মারল অনেক উঁচু থেকে, বোমারু বিমানের মতো নেমে পড়ল উঠোনের মাথায়, কী অসম্ভব চাতুর্যে যে সে বরইয়ের ডালপালার ফাঁক দিয়ে নেমে এল মাটির কাছাকাছি! বাড়ির লোকজনকে হতচকিত করে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে দুপায়ের নখরে গেঁথে ফেলল দুটি মুরগির ছানা, আর মুরগির রণমূর্তি আর চেঁচামেচি তোয়াক্কা না করেই খাড়া উঠে গেল পেয়ারার ডালপালার ফাঁক দিয়ে। ক্ষিপ্ত মুরগি উড়ল ওকে ধরার জন্য, ছানাদের উদ্ধার করার জন্য। ফল হলো না কিছুই। আকাশে শোনা যেতে লাগল মুরগির ছানা দুটির ‘টিউ টিউ’ কান্না। এক সময় তা মিলিয়ে গেল দূরে।
মুরগিটি তখনো রাগে ফুঁসছে। ‘কটর কটর’ ডাক ছেড়ে অন্য বাচ্চাদের কাছে ডেকে যেন গুনে দেখছে বাকি আটটা ছানা ঠিক আছে কি না! সে কিন্তু পাখিটির ডানার ছায়া দেখামাত্রই ছানাদের সতর্ক সঙ্কেত দিয়েছিল। অসম্ভব ক্ষীপ্র গতির ওই শিকারি পাখিটি পলাতক ছানাদের ভেতর থেকেই দুটিকে গেঁথেছে দুপায়ের নখরে। এরা তো পোষা মুরগি। হতো যদি সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের বন পাহাড়ের বনমুরগি, তাহলে শিকারি পাখিটি এভাবে ডাইভ মেরে সফল হতো না। বনমুরগি পোষা মুরগির চেয়ে অনেক বেশি চালাক। ওদের ছানারা সতর্ক সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালাতে পারে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায়। তবু শিকারি এই পাখিটি মাঝে-মধ্যে বনমুরগির বাচ্চাদেরও শিকার করে। সে ক্ষেত্রে কৌশলটা হয় একটু ভিন্নরকম। বনমুরগির ছানারা হয় খুব চতুর।
ভুবনচিল শঙ্খচিলের চেয়ে উড়তে যেমন পারে দ্রুত, তেমনি ডাইভ মারেও ভালো। ভুবনচিল পাক খেতে পারে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। অনেকক্ষণ পাখা না ঝাপটেও বাতাসে ভাসতে পারে সাবলীল ভঙ্গিতে। কয়েকটি বা কয়েক শ ভুবনচিল মিলে ঢাকার আকাশে মাঝেমধ্যে যেন ‘বউচি’ খেলায় মেতে ওঠে।
এবার আরেকটি শিকারি পাখির সাহস ও শিকার-কৌশলের কথা জানা যাক। একদল ছেলেপুলে একটি কালো গোখরো সাপকে ধাওয়া করে। চষাক্ষেতের মস্ত ভারি একখানা ঢিল ছুড়তেই তা পড়ল গিয়ে সাপটির কোমরে। পেটের তলায়ও ছিল ঢিল। কোমরে ঢিল পড়াতে সাপটির কোমর যায় ভেঙে। কোমরভাঙা কোনো সাপ আর পালাতে পারে না। কালো গোখরোটিও পারছিল না। তবে ফণা তুলে ফুঁসছিল দারুণ রোষে। পাড়াতেই ছিল একটি পোষাবেজি। ছেলে-পুলেদের মাথায় বুদ্ধি এল যে ওই বেজিটিকে এনে ‘সাপ-বেজির লড়াই’ দেখবে। বেজি এল। সাপ দেখে তেড়ে গেল। সাপের তো তখন মাথা খারাপ হওয়ার দশা। ছেলে-পুলেরা দাঁড়িয়েছে গোল হয়ে, হই-হল্লা করছে। সাপ-বেজির লড়াই দেখার জন্য উত্তেজিত সবাই। কিন্তু সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে, সবার মাথায় ডানার বাতাস খেলিয়ে শিকারি পাখিটি মাটিতে নেমেই নখরে গাঁথল সাপটিকে—এক পা দিয়ে ধরল সাপটির ঘাড়, অন্য পা দিয়ে ভাঙা কোমর আর সাঁই করে উঠে গেল অনেক ওপরে। লড়াকু বেজিটিও বুঝতে পারল না তার প্রতিদ্বন্দ্বী গেল কোথায়!
যে দুটি পাখির কথা বলা হলো, তার প্রথমটি ছিল শঙ্খচিল। দ্বিতীয়টি ভুবনচিল। দুরকম ভুবনচিল দেখা যায় বাংলাদেশে, এক রকম আমাদের নিজস্ব পাখি, অন্যটা পরিযায়ী। গোখরোটিকে নখরে গেঁথেছিল কিন্তু আমাদের দেশি ভুবনচিল।
শঙ্খচিল ও ভুবনচিলদের ওড়ার ভঙ্গি, ডাইভ মারার কৌশল, বাসার গড়ন-ধরন ও খাদ্য তালিকা প্রায় অভিন্ন। শঙ্খচিলের ডাককে ‘কান্না’ বলে মনে হয়—মনে হয় ডাকছে কারো করুণা ভিক্ষে করে। ওদের ছানাদের কান্না আরও করুণ। খিদে পেলে শঙ্খচিলেরা বেশি ডাকে, বাসা থেকে ডিম-বাচ্চা খোয়া গেলেও বেশি বেশি ডাকে, আবার অকারণেও ডাকে। সব সময়ই তার ডাকে যেন কান্না মিশে থাকে। অথচ মানুষের হাতে ধরা পড়লে ডাকাডাকি করেই না—যেন বোবা হয়ে যায়, চোখ দুটি যায় ঘোলা হয়ে। ছোঁ দিয়ে ভাসমান মাছ, হাঁস-মুরগির বাচ্চা, ছোট ছোট সাপ বা ব্যাঙ তুলে নিতে এরা ওস্তাদ।
ছেলেবেলায় বিল-ঝিলে মাছ ধরার সময় আমি যখনই নির্বিষ জলসাপ (কামড়াতেও জানে না এরা) পেতাম, তখন সাপটির লেজ ধরে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছুড়ে দিতাম শূন্যে, ঝাঁক থেকে কোনো একটি শঙ্খচিল ডাইভ মেরে শূন্য থেকেই নখরে ধরত সাপটি, অন্যরা করত ওকে ধাওয়া। তখন ওদের কাড়াকাড়ির খেলাটা হতো দেখার মতো। কী সুন্দর পাক যে খেত ওরা! এই সাঁ করে নেমে আসত নিচে, এই উঠে পড়ত খাড়াভাবে শূন্যে। কাড়াকাড়ির খেলায় এক সময় জিতে যেত একজন। সাপ নিয়ে সে চলে যেত বহুদূরে। ভুবনচিলেরাও শূন্য থেকে শিকার ধরতে ওস্তাদ।
যে দুটি পাখির কথা বলা হলো, তার প্রথমটি ছিল শঙ্খচিল। দ্বিতীয়টি ভুবনচিল। দুরকম ভুবনচিল দেখা যায় বাংলাদেশে, এক রকম আমাদের নিজস্ব পাখি, অন্যটা পরিযায়ী। গোখরোটিকে নখরে গেঁথেছিল কিন্তু আমাদের দেশি ভুবনচিল।
শঙ্খচিল পছন্দ করে গ্রাম। ঢাকার শহরতলীর লেক-জলাশয়ে কখনো কখনো দেখা যায়। বাসাও করে ঢাকা শহরে। পাশাপাশি, ভুবনচিলেরা পছন্দ করে শহর-নগর-বন্দর ও হাট-বাজার। ঢাকা শহরে প্রচুর ভুবনচিল আছে। ঢাকার আকাশে প্রায়ই চোখে পড়ে পাতিকাক বনাম ভুবনচিলের ‘ডগ-ফাইট’। পাতিকাকেরা জ্বালিয়ে মারে ওদের। কমলাপুর রেল স্টেশনের লাইটিং টাওয়ারগুলোর মাথায় বাসা করে যে ভুবনচিলেরা—ওদেরকে যে কী রকম উত্যক্ত করে পাতিকাকেরা! উৎসাহী যে কেউ ইচ্ছে করলে তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। সুযোগ পেলেই পাতিকাকের ডিম-বাচ্চা ছিনতাই করে ভুবনচিলেরা। পাতিকাকের তাই দু চোখের বিষ ওরা।
ভুবনচিল শঙ্খচিলের চেয়ে উড়তে যেমন পারে দ্রুত, তেমনি ডাইভ মারেও ভালো। ভুবনচিল পাক খেতে পারে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। অনেকক্ষণ পাখা না ঝাপটেও বাতাসে ভাসতে পারে সাবলীল ভঙ্গিতে। কয়েকটি বা কয়েক শ ভুবনচিল মিলে ঢাকার আকাশে মাঝেমধ্যে যেন ‘বউচি’ খেলায় মেতে ওঠে। সে এক অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। উৎসাহীরা দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। শুধু ঢাকা কেন, যে কোনো শহর-বন্দরের আকাশে ভুবনচিলদের কাণ্ড-কারখানা দেখা যাবে। ভুবনচিলেরা বহু ওপরে থেকে ডানা গুটিয়ে নিচের দিকে নামতে পারে শঙ্খচিলের চেয়ে দ্রুত গতিতে—মনে হয়, মাটিতে বুঝি আছড়ে পড়বে, কিন্তু পড়ে না।