আমাদের রংহীন জন্ম

ডক্টর পবন সিনহা অবাক হলেন। শিশুগুলোর চোখের ছানি অপারেশন করা হয়েছে। সুস্থ হয়ে গেছে ওরা। এখন ওরা সবকিছু দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সাদা-কালো ছবি ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না! জন্মের সময় শিশুগুলো দুচোখে এমন ঘন ছানি নিয়ে জন্মেছিল যে তারা কিছু দেখতেই পেত না। তবে এখন ওরা সুস্থ। ছানি অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ স্বাভাবিক শিশুরা যে সাদা-কালো ছবি সহজেই বুঝতে পারছে, এরা তা পারছে না। ব্যাপারটা কী?

বিষয়টা বুঝতে একটু জন্মের সময়ের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। চিন্তা করুন, আজ দুনিয়ায় আপনার প্রথম দিন। চোখ খুললেন। দুঃখিত। যা দেখতে পাবেন, সবই প্রায় সাদা-কালো এবং অস্পষ্ট, ঘোলা। আপনার জীবনের প্রথম দিনগুলো এমন রংহীন ছিল। কিন্তু তা আপনার মনে নেই। আসলে আপনার রেটিনা আর কর্টেক্স তখনো সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। এগুলো দিনদিন আরও উন্নত হবে। উন্নত হলে সব রং দেখতে পাবেন। কিন্তু এখন না। এখন এই অবস্থায় শুধু বুঝতে পারবেন কোনটা উজ্জ্বল, আর কোনটা অনুজ্জ্বল। আলোটা বেশি তীব্র নাকি কম। এটাই সাদা-কালো!

আরও পড়ুন

জীবনের প্রথম কিছু মাস এভাবেই চলবে। ঠিকঠাক রং দেখতে পাবেন না, সব অস্পষ্ট লাগবে। তবে এ সময় আপনার মস্তিষ্ক শুধু উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল চিনতে পারবে। কোনো কিছু কীভাবে দেখতে হয়, এ বিষয়ে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ লাগে। এখন আপনার চোখ রং দেখতে পাচ্ছে না, তাই তাকে উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বলের ওপর ভিত্তি করেই দেখার ট্রেনিং নিতে হবে। মস্তিষ্ক এই যে উজ্জ্বলতার ওপর ভিত্তি করে দেখা শিখল, এখানেই ঘটনা ঘটে গেছে। সে এখন সাদা-কালো বুঝতে পারে। কয়েকদিন পর যখন রেটিনা আর কর্টেক্স উন্নত হয়ে যাবে, যখন চোখের ‘কোন’ কোষ (এগুলোই রং দেখতে সাহায্য করে) উন্নত হয়ে উঠবে। তখন শুরু হবে রং দেখা। মোটামুটি এক বছর পর আপনি রঙিন দুনিয়া ঠিকঠাকভাবে রঙিন দেখবেন। তখন আপনার টিভি স্ক্রিনে সাদা-কালো সিনেমা হোক বা রঙিন, ঝামেলা নেই। আপনি বুঝতে পারবেন।

প্রশ্ন হলো, ডক্টর পবন সিনহার এক্সপেরিমেন্টে শিশুগুলোর দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল কেন? কারণটা হলো, যখন তাদের চোখের ছানি সরানো হয়েছিল, তখন তারা সঙ্গে সঙ্গেই রঙিন দুনিয়া দেখতে পায়। তাদের ‘কোন’ কোষগুলো উন্নত হয়ে গেছে, সেগুলোর বয়স হয়েছে। কিন্তু আলোর তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে যে ট্রেনিং হয়, তা হয়নি। মূলত তাদের মস্তিষ্কের দেখার ট্রেনিং শুরুতেই রং নির্ভর হয়ে গেছে। স্বাভাবিক শিশুদের যে আলোর তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে নিউরনে ট্রেনিং হয়, এদের তা হয়নি। তাই এই শিশুদের সামনে সাদা-কালো ছবি দিলে তারা হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, তাদের মস্তিষ্ক সাদা-কালোর সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। এ থেকে আমরা যা বুঝলাম, নিউরনের দেখার ট্রেনিং হয় দুভাবে—এক, আলোর ঔজ্জ্বল্যনির্ভর আর দুই, রং নির্ভর।

পুনম নামের এই মেয়েটির চিকিৎসা করেছেন ডক্টর পবন সিনহা
ছবি: এমআইটি নিউজ
কারণটা খুব সহজ। অন্ধকারে আমরা যা দেখি, তা সাদা-কালো, অর্থাৎ আলোর ঔজ্জ্বল্যের ওপর ভিত্তি করে দেখি। বিপরীতে মস্তিষ্ক যদি শুরুতে সাদা-কালোতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে রঙিন ছবি বুঝতে অসুবিধে হয় না। মস্তিষ্ক তখন আরও গাঢ় ও হালকা রঙের পার্থক্য সূক্ষ্মভাবে বুঝতে পারে

তবু বিষয়টাকে আরও খতিয়ে দেখা দরকার। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) কয়েকজন অধ্যাপক আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করলেন। এতে তাঁরা ব্যবহার করেন অ্যালেক্সনেট (Alexnet)। এটি নিউরনের নিউরাল নেটওয়ার্কের আদলে তৈরি দৃষ্টিশক্তির কম্পিউটেশনাল মডেল। মানে মস্তিষ্কে নিউরনগুলো ঠিক যেভাবে কাজ করে, নিউরনের মাধ্যমে ঠিক তার আদলে বানানো একটি কম্পিউটার মডেল। অ্যালেক্সনেটকে প্রথমে বেশ কিছু সাদা-কালো ছবি দেখানো হলো। তারপর দেখানো হলো একগুচ্ছ রঙিন ছবি। একদম স্বাভাবিক শিশুরা যেমন দেখে, ঠিক সেরকম। অর্থাৎ, জন্মের পর প্রথমে সাদা-কালো এবং তারপর ধীরে ধীরে রঙিন পৃথিবী দেখার মতো। এই পরীক্ষায় দেখা গেল, দুই ধরনের ছবিই বুঝতে পারছে ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলটি।

এবার অ্যালেক্সনেটকে আবার রিসেট করে প্রথম থেকে শুরু করা হলো। প্রথমে রঙিন ছবি দেখিয়ে তারপর দেখানো হলো সাদা-কালো। অনেকটা ডক্টর পবন সিনহার সেই শিশুদের মতো। এবার দেখা গেল অ্যালেক্সনেট রঙিন ছবি ঠিকঠাক বুঝতে পারলেও সাদা-কালো ছবিগুলো ধরতে পারছে না। সেই শিশুদের মতো সাদা-কালো ছবি বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে।

আরও পড়ুন

ব্যাপারটা একদম সহজ। মস্তিষ্ক শুরুতে রংনির্ভর দুনিয়া দেখলে সাদা-কালো দুনিয়া বুঝতে অসুবিধে হবে। সে সারাক্ষণ রং খুঁজতে থাকবে। এ জন্যই পবন সিনহার ছানি সারানো শিশুগুলো রাতে বা অন্ধকারে ঠিকভাবে দেখতে পায় না। কারণটা খুব সহজ। অন্ধকারে আমরা যা দেখি, তা সাদা-কালো, অর্থাৎ আলোর ঔজ্জ্বল্যের ওপর ভিত্তি করে দেখি। বিপরীতে মস্তিষ্ক যদি শুরুতে সাদা-কালোতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে রঙিন ছবি বুঝতে অসুবিধে হয় না। মস্তিষ্ক তখন আরও গাঢ় ও হালকা রঙের পার্থক্য সূক্ষ্মভাবে বুঝতে পারে। তখন রঙিন থেকে সাদা-কালো—কিছুতেই আর সমস্যা হয় না। ফলে দেখা যাচ্ছে, জন্মের পর শিশুরা যে শুরুতেই রঙিন ছবি না দেখে সাদা-কালো দেখে, মানে অপরিপক্ব দর্শনব্যবস্থা নিয়ে জন্মায়, তা আসলে অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত

সূত্র: DOI: 10.1126/science.adk9587