হাজার জিনোম প্রকল্প

জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পর পুরো জিনোমের সিকোয়েন্সটা সরাসরি পাওয়া যায় না, বরং অসংখ্য ছোট ছোট খণ্ডের সিকোয়েন্স পাওয়া যায়। এগুলোকে বলে রিডস (reads)। যে কারও জিনোম সিকোয়েন্স করার পর এর কোন অংশে কী আছে, তা জানার জন্য এই রিডসগুলোকে অ্যালাইন (align) বা ম্যাচিং করা হয় একটি রেফারেন্স জিনোমের সঙ্গে। এই রেফারেন্স জিনোমই প্রথম যখন সিকোয়েন্সিং করা হয়, সেই গল্পটা কিন্তু বেশ মজার। সেলো জিনোমিকস আর হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের মধ্যে হয়েছিল জম্পেশ প্রতিযোগিতা—কারা আগে সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স প্রকাশ করবে। ফলে প্রস্তাবিত সময়েরও অনেক আগে মানুষের জিনোমের একটি পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্স প্রকাশিত হয়। তবে এ সিকোয়েন্সটি কোনো একজন ব্যক্তির সিকোয়েন্স ছিল না। বেশ কয়েকজন ডোনারের ডিএনএর মিশ্রণ থেকে এই সিকোয়েন্স পাওয়া গিয়েছিল। কোনো একজন ব্যক্তি বা কোনো একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যেক ব্যক্তির জিনোমে বিশেষ কোনো সিকোয়েন্স থাকতে পারে। রেফারেন্স জিনোম তৈরি করতে যাদের জিনোম ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের জিনোমে এই বিশেষ সিকোয়েন্স ছিল না।

২৬টি জাতিগোষ্ঠীর প্রায় আড়াই হাজার ব্যক্তির জিনোম সিকোয়েন্সের কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে। সেই প্রকল্পেরই নাম থাউজেন্ড জিনোম প্রজেক্ট। এই আড়াই হাজার জনের মধ্যে রয়েছে ১৪৪ জন বাংলাদেশি। ২০১২ সালে ১৪টি জাতিগোষ্ঠীর ১ হাজার ২৬ জনের জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন হয়। সত্যি সত্যিই রেফারেন্স সিকোয়েন্সের সঙ্গে তুলনা করে এই সিকোয়েন্সগুলোতে গড়ে ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন জায়গায় পার্থক্য পাওয়া গেল। এ পার্থক্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মাত্র একটি নিউক্লিওটাইডের পার্থক্য (সিঙ্গেল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম বা এসএনপি)। কয়েকটি নিউক্লিওটাইডের ইনসারশন (insertion) বা ডিলিশন (deletion), কোনো বিশেষ নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্সের একেক জিনোমে একেক রকম সংখ্যা ইত্যাদি। এগুলোকে বলা হয় ভেরিয়েন্ট (variant)।

ভেরিয়েন্টের গুরুত্ব অনেক। দুজন মানুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে এই ভেরিয়েন্টগুলো। বহু ক্ষেত্রেই কোনো বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইটের (trait) সঙ্গে সম্পর্ক পাওয়া গেছে তার জিনোমে উপস্থিত ভেরিয়েন্টের। এই ট্রেইট হতে পারে শারীরিক বা আচরণগত কোনো বৈশিষ্ট্য, কিংবা কোনো অসুখের প্রতি তার সংবেদনশীলতা। যেমন বাংলাদেশি ডায়াবেটিস রোগীদের জিনোমে পাওয়া গেছে বিশেষ কিছু এসএনপি। ভেরিয়েন্টগুলো শুধু রোগ নির্ণয়ে বা চিকিৎসাতেই ভূমিকা রাখে না বরং গবেষণায় এগুলোকে টার্গেট করলে সহজ হয়ে যায় এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন বা ম্যানিপুলেট করা। এসব বিবেচনায় আরও বেশ কিছু জিনোম সিকোয়েন্স প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এশিয়ান হলেও বিভিন্ন জিনোম গবেষণায় এশিয়ানদের স্যাম্পল ছিল সীমিত। এটা মাথায় রেখে উদ্যোগ নেওয়া হয় ‘জিনোম এশিয়া ১০০কে’ প্রকল্প। এই প্রকল্পে দক্ষিণ এশিয়ার ১২টি দেশ এবং উত্তর ও পূর্ব এশিয়ার ৭টি দেশ থেকে ১ লাখ মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। এই যে এত এত টেরাবাইট আকারের ডেটা তৈরি হচ্ছে, সেগুলো লুফে নিচ্ছেন চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের গবেষকেরা। যেমন ফার্মাকোজিনোমিকসের কথাই ধরা যাক। একজন রোগীর শরীরে একটা ওষুধ কতটুকু কাজে লাগাবে, তা নির্ভর করে কিছু জিনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ওপর। কিন্তু থাউজেন্ড জিনোম প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, শুধু জিনের উপস্থিতিই নয়, তাতে ভেরিয়েন্ট কী আছে, সেটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই প্রকল্পে থেকে ওষুধের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সব জিন ও তাদের ভেরিয়েন্টগুলোকে একত্র করে তৈরি হলো আলাদা একটি ডেটাবেইস। এখান থেকে সহজেই ওষুধ বা সংশ্লিষ্ট জিনের নাম দিয়ে আমরা জানতে পারব, জিনের কোন কোন ভেরিয়েন্ট হওয়া সম্ভব। রোগীর জিনোমে কোনো বিশেষ ভেরিয়েন্ট উপস্থিত থাকলে ওষুধ কেমন কাজ করবে, সেটাও জানা যাবে।

আমার নিজের একটি গল্প বলি। আমার বাবার হার্ট অ্যাটাকের পর ব্যথা কমাতে তাঁকে অ্যাসপিরিন গোত্রের একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তার এক মাস পর আবার দেখা করতে বললেন। এই এক মাসে অ্যাসপিরিনে ব্যথা কখনোই পুরোপুরি উপশম হতো না। এক মাস পর ডাক্তার বিষয়টা জানতে পেরে CYP2C9 জিনের সিকোয়েন্স করতে বললেন । দেখা গেল বাবার জিনোমে এই জিনের এমন একটি ভেরিয়েন্ট আছে, সেটা অ্যাসপিরিনকে সহজে ভাঙতে বা মেটাবোলাইজ করতে পারে না। ডাক্তার অ্যাসপিরিনের ডোজ বাড়িয়ে দিলেন। ব্যথা কমতে থাকল!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্টডক্টরাল ফেলো, লুনেনফেল্ড-টানেনবাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট, টরন্টো