সোনালি আঁশের সোনালি নকশা

একসময় পাট আমাদের দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। এ দেশে মূলত সাদা পাট ও তোষা পাটের চাষ হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত বেশ কিছু জাত রয়েছে। অনেকেই খাবার টেবিলে পাটের শাক পছন্দ করে থাকেন। পাটের সোনালি আঁশকে কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় এটা কতটা মুগ্ধকর একটি তন্তু। হাতে ধরতে ততটা নরম না হলেও এটি অনেক মজবুত, ফলে পাটের তৈরি বস্তা, কাপড়, ব্যাগ, পর্দা এবং বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য জিনিস দেখা যায়। বাংলাদেশের জলবায়ু পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এবং সবচেয়ে উন্নত মানের পাট হয় আমাদের দেশে। কালের প্রবাহে আধুনিক কৃত্রিম তন্তুর বেড়াজালে পড়ে আমাদের পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়। পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে জেতে লাগল, পাটচাষিরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। পাটের প্রাকৃতিক তন্তু থেকে তৈরি ব্যাগ ব্যবহারে আমরা হয়তো পরিত্রাণ পেতে পারি কৃত্রিম পলিথিন ব্যাগের হাত থেকে। অথবা পাটের তন্তু যদি আর একটু নরম করা যায়, আমরা হয়তো একে পরিধানের বস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করতে পারি। বর্তমানে পাটের এ রকম ব্যবহার ব্যয়বহুল। ফলে উৎপাদন হলেও বাজারজাত করা যায় না।

সময়টা ২০১০ সালের জুন মাস। সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, একদল বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর পাটের জীবনরহস্য উদ্‌ঘাটনের কাহিনি। সারা বিশ্ব কিছুটা অবাক হয়েছিল বৈকি। বিশেষ করে তখন সময়টা ছিল ২০১০ সাল, মানুষের সম্পূর্ণ জিনোমই সিকোয়েন্স হয়েছে কেবল ১০ বছর হলো। এখনকার যুগের জিনোমিকস অ্যানালাইসিসের মতো এত বেশি বায়োইনফরমেটিকস টুল তখন ছিল না। ডিএনএ সিকোয়েন্স করার প্রযুক্তিও ছিল অপ্রতুল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়, কিছু প্রগতিশীল বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে এবং একদল উদ্যমী গবেষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সম্ভব হয়েছিল এই অসাধ্য সাধন। পাটের জিনোমের মেধাস্বত্ব এবং এর দুটি জাতের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে জিনোমের তথ্যসংবলিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পায় ২০১৭ সালে বিখ্যাত নেচার পাবলিকেশন গ্রুপের নেচার প্ল্যান্ট জার্নালে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল এবং প্রাকৃতিক তন্তুর অন্যতম উৎস হিসেবে এই সোনালি আঁশের জিনোম–রহস্য নিঃসন্দেহে পাটের উৎপাদন এবং গুণগত মান উন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।

পাটের আশ

পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রজেক্ট

এবার ঘুরে আসা যাক ২০১০ সালেরও অনেক বছর আগে থেকে। দেশ বরেণ্য জীববিজ্ঞানী প্রফেসর আহমদ শামসুল ইসলাম প্রথম দেশী ও তোষা পাটের সংকরায়ন করেন ষাটের দশকে যা অনেকটা অসাধ্য কাজ ছিল এবং প্রকাশ হয়েছিল বিখ্যাত নেচার সাময়িকী তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলেকুলার বায়োলজি বিভাগের বিজ্ঞানী প্রফেসর হাসিনা খানের ল্যাবে অনেক দিন ধরে পাটের বিভিন্ন জিন নিয়ে কাজ চলে আসছে। কোনো একটি জীবের জিনোমের তথ্যটুকু জানা থাকলে অনেক কাজই সহজ হয়ে যায়। পাটের বিভিন্ন জাতের মধ্যে ভিন্নতা একটু কম এর ফলে সনাতন পদ্ধতিতে প্রজনন প্রক্রিয়ায় এর উন্নত জাত পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাছাড়া টিস্যু কালচার পদ্ধতিও পাটে খুব একটা কাজ করেনা। এজন্য বিভিন্ন উপকারী বা অপকারী জিন সনাক্ত করে সেগুলোকে ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় আরেকটি পাটের জাতে প্রবেশ করিয়ে জেনেটিকালি ট্রান্সফরমড পাট তৈরি করেছে ড. হাসিনার গবেষকদল। এবার আসা যাক আরেকজন বিজ্ঞানীর কথায়। ড. মাকসুদুল আলম হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক কিন্তু আমাদের বাংলাদেশেরই ছেলে। তিনি হাওয়াইয়ান পেঁপের জিনোম সিকোয়েন্স করে পেঁপের রিং ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষার উপায় বাতলে দেন। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ান সরকারের আমন্ত্রনে তাদের রাবারের জিনোমের সিকোয়েন্সিংয়ে নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রফেসর আহমদ শামসুল ইসলামের আমন্ত্রণে তিনি দেশে আসেন। জিন বিজ্ঞানী ড. হাসিনা খান, ড. জেবা ইসলাম সেরাজ, ড. আবেদ চৌধুরীসহ অন্য সবার সঙ্গে তারও একই স্বপ্ন। আমাদের পাটের জিনোমের সিকোয়েন্স করা। কিন্তু এই বিশাল খরচ বহন করবে কে, সরকার কি এতটা সাহায্য করবে? আমাদের জিন বিজ্ঞানীগণ লেগে গেলেন সবার সামনে জিনোম সিকোয়েন্সের উপকারিতা এবং এতে বাংলাদেশ কিভাবে উপকৃত হতে পারে তা তুলে ধরতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গোল টেবিল বৈঠকে তৎকালীন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এলেন বিজ্ঞানীদের বক্তব্য শুনতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি জনাব আরেফিন সিদ্দিকীর অনুরোধে এবং ড. হাসিনা খান ও ড. জেবা ইসলাম সেরাজের উদ্যোগে। ড. জেবা ব্যাখ্যা করলেন, কিভাবে ধানের জিনোম সিকোয়েন্স ব্যবহার করে তার গবেষকদল উপকৃত হচ্ছে লবণ সহনশীল ধান উদ্ভাবনে। ড. হাসিনা খান উপস্থাপন করেন কিভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স জানা থাকলে পাটের গবেষণা আরও ত্বরান্বিত ও উন্নত হবে। ড. হাসিনা তার বক্তব্য শেষ করেন ড. মাকসুদুল আলমের হাওয়াইয়ান পেঁপের জিনোমের সাফল্যের কথা বলে। এই বৈঠকের ওপর বেশ বড় করে পরে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান প্রথম আলো পত্রিকায় লেখেন। এর ফলে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স করার তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ পাটশিল্প রক্ষায় এর ভুমিকা উপলদ্ধি করতে আমাদের বিচক্ষণ কৃষিমন্ত্রীর উপলব্ধি করতে দেরি হয়নি।

পাটের তৈরি দড়ি

পাটের জিনোম সিকোয়েন্স প্রজেক্ট থেকে শুধু যে পাটের জিনোমের ক্রমবিন্যাস জানা যাবে তা নয়, এতে একদল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষক দল তৈরি হবে যারা পরবর্তীতে অন্যদের প্রশিক্ষিত করবে। এভাবে আধুনিক জীববিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা অবদান রেখে যাবে। অনেকটা সেই তিন গোয়েন্দা সিরিজের ভূত থেকে ভূতের মত। এক জনের কাছ থেকে ৩ জন শিখবে আবার সেই ৩ জনে আরও ৩ জনকে শিখিয়ে মোট ৯ জন শিখবে। তিনটি ভিন্ন দলের সমন্বয়ে তৈরি হল গবেষকদল স্বপ্নযাত্রা। এখানে থাকল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলেকুলার বায়োলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা, ডেটাসফট বাংলাদেশের কিছু তরুণ বিজ্ঞানী। নেতৃত্বে থাকলেন ড. মাকসুদুল আলমের সঙ্গে ড. হাসিনা খান, ড. মাহবুব জামান। তাদের সঙ্গে ছিলেন সবসময় ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ড. জেবা ইসলাম সেরাজসহ আরও অনেকে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এই যাত্রায় অংশ নেন এবং পরবর্তীতে ড. মাকসুদুল আলমসহ বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের তৎকালীন মহাপরিচালক ড. কামালউদ্দিন এবং পরিচালক ড. মনজুরুল করিমের তত্ত্বাবধায়নে পথ চলা শুরু হয় পাট বিষয়ক মৌলিক এবং ফলিত গবেষণা প্রকল্পের। জিনোম সিকোয়েন্সে প্রজেক্টের পুরো দলটির মধ্যে কাজ করত দেশপ্রেম। তাই সবাই আত্মস্থ করে নিয়েছিল এ কাজে সফল হতে হবে যেন বাংলাদেশের জন্যেই। হাজার হলেও বাংলাদেশের সকল মানুষের অংশীদার, সরকারের আর্থিক সহায়তায় পাটের জিনোম প্রজেক্টের পথচলা।

জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের হাতেখড়ি

প্রতিটি জীবের কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াসে ডিএনএ থাকে, যা তৈরি হয় ৪টি রাসায়নিক পদার্থ বা বেস (ক্ষার) দিয়ে। অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), থায়মিন (T) ও সাইটোসিন (C) । নিঃসন্দেহে এটি অবাক করার মতো বিষয় যে কীভাবে এই চারটি অক্ষরের বিন্যাস ও সমাবেশে তৈরি হয় আমাদের জীবনের নকশা। জিনোম সিকোয়েন্স করে আমরা মূলত জানতে পারি কোন বেসের পরে কোন বেস থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বিন্যাস সমাবেশের মধ্যে আবার কিছু প্যাটার্ন তৈরি হয়। যেমন A, T, G—এ তিনটি বেস পরপর থাকলে সেখানে একটি জিনের সূচনা হতে পারে। তাই বলে যেকোনো A, T, G–কেই জিনের সূচনা বলা চলবে না। এর সঙ্গে আরও কিছু প্যাটার্ন থাকতে হবে, যেখানে এসে জিনের সূচনাকারী প্রোটিন (ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর) বসতে পারে। এই অংশটিকে বলে প্রমোটার, যাকে অনেক সময় চেনা যায় কিছু বিশেষ বেসের সমাবেশে। যেমন পরপর T ও A–এর একটি বিশেষ সমাবেশ থাকলে একে T A T A বক্স বলে, যা প্রমোটার চেনার একটি অন্যতম উপায়। জিনোম সিকোয়েন্স করার ফলে আমরা আসলে জানতে পারি কোন বেসের পরে কোন বেসটি আছে। এরপর আমরা বায়োইনফরমেটিকসের বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই ছড়িয়ে থাকা প্যাটার্নগুলো খুঁজে বের করতে পারি। চিহ্নিত করতে পারি, কোথায় জিনের শুরু কোথায় জিনের শেষ, কোথায় প্রমোটার আছে, কোথায় জিনের প্রকাশকারী অংশ আছে ইত্যাদি। এ জন্যই জিনোমকে বলা হয়ে থাকে জীবনের নকশা। এই যে জিনের সূচনা বা শেষ হওয়া, এগুলোর মধ্যে সামান্য হলেও ভিন্নতা থাকে একই রকমের দুটি প্রাণী বা উদ্ভিদের জাতে। আমাদের সবার জিনোম এই A, T, C, G দিয়ে তৈরি। কিন্তু এই বিন্যাস সমাবেশে ভিন্নতার কারণে কেউ হয়তো মানুষ, কেউ পাট, আবার কেউ ছত্রাক।

অনেকেই হয়তো মলিকুলার বায়োলজির মূল মতবাদ বা সেন্ট্রাল ডগমা সম্পর্কে জানেন। এই মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি জীবে ডিএনএ থেকে আরএনএ এবং আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি হয়। প্রথম ধাপটির নাম ট্রান্সক্রিপশন এবং পরের ধাপটির নাম ট্রান্সলেশন। আবার ডিএনএ থেকেও ডিএনএ তৈরি হয়, একে বলে রেপ্লিকেশন। এ ছাড়া আরএনএ থেকেও ডিএনএ তৈরি হতে পারে, একে বলে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন।

যখন আমরা বলি একটি জিনের এক্সপ্রেশন হয়েছে বা প্রকাশ ঘটাচ্ছে, এর অর্থ হলো ডিএনএ থেকে জিনটির আরএনএ তৈরি হয়েছে। এই আরএনএর পরিমাণ আমাদের দেহে সব সময় একই রকম থাকে না। যখন খুব গরম লাগে তখন হয়তো কিছু জিনের আরএনএ বেড়ে যায় এই গরম সহ্য করার জন্য। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এ রকমটি ঘটে। এই যে আরএনএর পরিমাণ কমবেশি হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা বুদ্ধি করে এটা মাপার উপায়ও বের করে ফেলেছেন। ব্যাপারটা খুব সহজ। কিছু আরএনএকে যদি আমরা সিকোয়েন্স করি, যে জিনের আরএনএ বেশি তার রিডসের সংখ্যাও বেশি হবে। এভাবে আমরা আরএনএর কমবেশি সংখ্যা গণনা করতে পারি। একেই বলে আরএনএ সিকোয়েন্সিং। ল্যাবরেটরিতে আরএনএ আলাদা করে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন করে আরএনএ থেকে ডিএনএ করা হয়, যাকে বলে সিডিএনএ। এরপরে এদের সিকোয়েন্সিং করা হয়। একটি বিশেষ সময়ে যতগুলো এমআরএনএ আছে, তাদের একত্রে ট্রান্সক্রিপটম বলে। ঠিক যেমন সব জিন এবং জিনের নিয়ন্ত্রণকারী উপাদানগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় জিনোম। একইভাবে একটি জীবের সব প্রকাশিত প্রোটিনকে একত্রে বলে প্রোটিওম। এভাবে এখনকার যুগটা হয়ে গেছে অমিকসের যুগ, আছে মেটাবলমিকস, ফেনমিকস ইত্যাদি।

কোনো জীবের জিনোম সিকোয়েন্স করা বলতে আমরা বুঝি তার ডিএনএটা আলাদা করে এর ক্রমবিন্যাসটা নির্ধারণ করা। এ ব্যাপারটা কিন্তু খুব সহজ নয়; সেই ষাটের দশকে বিজ্ঞানী স্যাঙ্গার এই ক্রমবিন্যাস নির্ধারণের একটি পদ্ধতি বের করেন। এটা সম্ভব হয়েছিল ডিএনএ A, T, C, G নামের এই চারটি রাসায়নিক বেস দিয়ে তৈরি বলে। ডিএনএর সম্পূর্ণ ফর্ম হলো ডিঅক্সিরাইবনিউক্লিক অ্যাসিড। যার মানে পুরো গঠনটিতে একটি অক্সিজেন মিসিং থাকবে, তিনি করলেন কি এই চারটি বেসের মতোই কিছু পরিবর্তিত বেস দিয়ে ল্যাবরেটরিতে পিসি‌আর করে ডিএনএ তৈরি করলেন। এই পরিবর্তিত বেসগুলোতে দুটি অক্সিজেন মিসিং। ফলে এদের নাম হলো ডাই ডিঅক্সিরাইবনিউক্লিক অ্যাসিড। এ ছাড়া এদের সঙ্গে কিছু ফ্লুরোসেন্স ট্যাগ করে দিলেন, চারটির জন্য চার রং। এই পিসি আর বিক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই বিক্রিয়ায় ডিএনএকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া যায়। প্রথমে ডিএনএ, চারটি বেস, চারটি পরিবর্তিত বেস এবং ডিএনএ তৈরির অন্যান্য উপাদান দেওয়া হয়। ডিএনএ তৈরি হতে হতে যখনই কোনো একট পরিবর্তিত বেস পায়, তখনই বিক্রিয়া থেমে যায় এবং ফ্লুরোসেন্সের রং প্রদর্শন করে। এভাবে একটা একটা করে বেস দিয়ে ডিএনএটা বাড়তে থাকে এবং একসময় সব পজিশনেই একটি না একটি পরিবর্তিত বেস ব্যবহৃত হয়। ওই পজিশনে আসলে কোন বেসটি আছে, তা ফ্লুরোসেন্সের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। এই উপায়ে ছোট জিনগুলোর সিকোয়েন্স জানা যয়। কিন্তু একটি জীবের সব জিনের ক্রম জানা এ পদ্ধতিতে অনেক ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স প্রথমে এভাবেই করা হয়েছিল।

এখনকার যুগে জিনোম সিকোয়েন্সের টেকনোলজি অনেকটা উন্নত। ফ্লুরোসেন্স ট্যাগের ব্যবহার কমবেশি সব টেকনোলজিতে আছে। ইলুমিনা, সলিড, ৪৫৪, অক্সফোর্ড ন্যানোপোর এ রকম কিছু আধুনিক টেকনোলজি। এদের মূল সমস্যা, এরা ডিএনএকে ছোট ছোট খণ্ডে সিকোয়েন্স করতে পারে। স্যাঙ্গারে যেখানে ৮০০ বেস একত্রে করা যায়, এরা হয়তো ১০০ বা ১৫০ বা ৪৫০ একত্রে করতে পারে। একমাত্র অক্সফোর্ড ন্যানোপোর আরএনএ সরাসরি সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়।

পাটের জিনোম করার জন্য এই নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং করা হয়, এরপরে এই খণ্ড ক্রমগুলো পরপর সাজানো হয় ঠিক পাজল মেলানোর মতো। একে বলে অ্যাসেম্বলি। এর মধ্যে আরও কিছু ফাইন টিউনিং ধাপ থাকে, যেমন আমাদের জিনোমে অনেক রিপিট থাকে। অনেকখানি অংশজুড়ে হয়তো পরপর অনেক A বা অনেক T। প্রাথমিকভাবে এদের মাস্ক করে বা সরিয়ে রাখা হয়। কারণ, পাজল মেলানোর সময় এরা সমস্যা তৈরি করতে পারে। এরপরের সিকোয়েন্সের প্যাটার্ন মিলিয়ে বের করা হয় কোথায় জিনের শুরু বা শেষ, কোথায় প্রমোটার ইত্যাদি। একে বলে অ্যানোটেশন। মূলত এই পদ্ধতিটি হচ্ছে স্ট্রাকচারাল বা গঠনগত অ্যানোটেশন। আরেক ধরনের অ্যানোটেশন আছে। তাকে বলে ফাংশনাল অ্যানোটেশন। সেট আগের পাবলিক ডেটাবেসে থাকা কোনো জিনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয় ব্লাস্ট নামের একটি টুলের সাহায্যে। ফলে আগে থেকে জিনটির কাজ জানা থাকলে, নতুন সিকোয়েন্স করা জিনোমটির ক্ষেত্রেও জিনের কাজটা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।

পাটের জিনোম নকশা

পাটের জিনোম প্রকল্পের গবেষকদের প্রথম লক্ষ্য ছিল রোগ–বালাইয়ের জন্য দায়ী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে জিনগুলো দরকার, সেগুলো শনাক্ত করা। পাটের ডিএনএ খণ্ড খণ্ড করে সিকোয়েন্স করে সেগুলোর জিন বিশ্লেষণ করা খুব সোজা ছিল না। তাই কাজ চলছিল খুব ধীরগতিতে। একসময় সেটা সম্পন্ন হলো। এরপরই ভাইরাস বা ছত্রাকরোধী জিনগুলো শনাক্তকরণের কাজটি অনেক সহজ হয়ে গেল। অন্যান্য জীবের জিনের সিকোয়েন্সের সঙ্গে মিলিয়ে পাটের জিনগুলোর কাজ সম্পর্কে ধারণা পেলেন গবেষকেরা। অর্থাৎ গবেষকদের হাতে একটি হাতিয়ার চলে এল। এর সাহায্যে তাঁরা জানতে পারলেন, ঠিক কোন অংশে পরিবর্তন করলে একটি জিনের কার্যকারিতা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। এ অবস্থায় একটি জিনকে অকার্যকর করে বিজ্ঞানীরা সেই জিনটির প্রকৃত কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন। এ ঘটনাকে বলে জিনের মিউটেশন।

পাটের জিনোম সিকোয়েন্স করার পরে অন্য ১৩টি উদ্ভিদ জিনোমের সঙ্গে এর সম্পর্ক দেখা হয়েছে। দেখা গেছে, মালভেসি পরিবারের কাকাও এবং তুলার জিনের সঙ্গে পাটের জিনের বেশ মিল রয়েছে। ক্লোরোপ্লাস্টের ডিএনএ দিয়ে ফাইলোজেনেটিক বিশ্লেষণ করেও একই ফলাফল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পাটের দুটি জাতের মধ্যে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্যের জিন পাওয়া গেছে, এই বিশেষ জিনগুলো এই পরিবারের অন্য উদ্ভিদের মধ্যে নেই। ফাইবার তন্তুর কোষগুলোতে কোন কোন জিনের এক্সপ্রেশন বেশি, সেটা বোঝার চেষ্টা করা হয় একটা বিশেষ পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে অলিটরিয়াস এবং ক্যাপসুলারিসের আরএনএ সিকোয়েন্সিং তথ্যের তুলনা করা হয় এবং কিছু বিশেষ জিন শনাক্ত করা যায়। পাটের মূল ব্যপারটাই হলো এর তন্তু। তন্তুই পাটের উৎপাদন এবং গুণগত মানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফাইবার কোষে বিশেষভাবে প্রকাশ পাওয়া কিছু জিন শনাক্ত করতে সক্ষম হন গবেষকেরা। এই জিনগুলো ভাসকুলার ক্যাম্বিয়ামের জন্ম এবং বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

পাটে যদি ১৫ শতাংশ লিগনিনের উপস্থিতি থাকে, তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হবে। এর তন্তু শণ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর তুলনায় খসখসে হয়। কারণ, শণে লিগনিনের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও বেশি লিগনিন পাটের তন্তুকে মজবুত করে। দেখা গেছে, সাদা পাটের তুলনায় তোষা পাটে লিগনিন বেশি, সেলুলোজ কম। আবার রঙের জন্য দায়ী এনজাইমগুলোর জিনের পার্থক্য আছে। আর এই পার্থক্যের কারণেই তোষা পাটের রং সোনালি কিন্তু সাদা পাটের রং সাদা। এ ছাড়া সাদা পাট তোষা পাটের তুলনায় বন্যা ও খরাসহিষ্ণু। কিন্তু রোগ–বালাই আবার সাদা পাটেই বেশি আক্রমণ করে।

পাটের কাণ্ড পচা রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের জিনোম

পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেই পাটের মৌলিক ও ফলিত গবেষণার প্রতিষ্ঠানটির কাজ থেমে থাকেনি। এরপর গবেষকদলটি পাটের কাণ্ড পচা রোগের জন্য দায়ী ছত্রাক ম্যাক্রফমিনা ফ্যাসিওলিনার জিনোম সিকোয়েন্স করেন। কাণ্ড পচা রোগের আক্রমণে পাটের ফলন ৩০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। পাটের বিশেষ একটি জাত আছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে, যা ধবধবে সাদা আঁশযুক্ত। এর ফলে এটাকে বিনা ব্লিচিংয়ে পাটপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এতে একদিকে যেমন এর উৎপাদন খরচ কমে যায়, পরিবেশও ভালো থাকে। সমস্যা হলো এই জাতটি কাণ্ড পচা রোগে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। ফলে জাত হিসেবে কৃষকের কাছে অজনপ্রিয়। ম্যাক্রফমিনা ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্স এখন অনেক তথ্য দেবে বিজ্ঞানীদের। ম্যাক্রফমিনা কোন জিন ব্যবহার করে, এটি পাটের কাণ্ড পচা রোগ সৃষ্টি করে, তা এখন সহজেই জানা যাবে এবং সেই অনুযায়ী পাটের কিংবা এই ছত্রাকে জিনোম পরিবর্তন করে কাণ্ড পচার কার্যকারিতা সীমিত করে দেওয়া যাবে।

পাটের জিনোম এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

বিশ্বজুড়ে চলছে জিনোম সিকোয়েসিংয়ের যুগ। কম্পিউটারের কম্পিউটেশন ক্ষমতাও সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, জিনোমের তথ্যগুলো কম্পিউটারে অনেক জায়গা দখল করে। জিনের তথ্য বিশ্লেষণের জন্য লাগে সুপারকম্পিউটার, এর গণনা ও প্রসেসিং ক্ষমতা অনেক বেশি। একই সঙ্গে বায়োইনফরমেটিকস এবং জীববিজ্ঞানে দক্ষতাও জরুরি। প্রথম দিকে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজগুলো করা হয়েছিল মালয়েশিয়ায় এবং কম্পিউটেশনাল বিশ্লেষণগুলো করা হয়েছে বাংলাদেশে। এখন বাংলাদেশেই রয়েছে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং সিস্টেম। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে সফলতা পেতে আমাদের লাগবে দক্ষ জনবল।

দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে জিনোম সিকোয়েন্স থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে পাটের জাত উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলছে। এ ছাড়া পাটের জিনোম থেকে পাওয়া তথ্য থেকে ২টি পেটেন্ট এবং ছত্রাকের জিনোম থেকে ৩টি প্রভিশনাল পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে মেধাস্বত্ব অর্জনের লক্ষ্যে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্পটি সম্পন্ন করা হয়। এটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, উন্মুক্ত করেছে বাংলাদেশে আরও জীবের জিনোম সিকোয়েন্স করার সম্ভাবনা। পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা মাকসুদুল এখন আর পৃথিবীতে নেই। তবে জিনোম সিকোয়েন্সের সাহায্যে তৈরি করা উৎকৃষ্ট মানের পাটের জাত কৃষকের হাতে তুলে দিতে পারলেই হবে তাঁর স্বপ্নের প্রকৃত বাস্তবায়ন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভারসিটি বাংলাদেশ এবং সহযোগী, প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ল্যাব, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়