যে কৌশলে মশা রক্ত খায়

মশা সাধারণত গাছের মিষ্টি নির্যাস, ফুলের মধু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারন করে। পুরুষ মশা শুধু এগুলোই খায়। স্ত্রী মশারাও খায়। কিন্তু স্ত্রী মশা মানুষ বা প্রাণীর রক্তও খায়। মূলত ডিম উত্পাদনের জন্য এদের রক্তের প্রয়োজন হয়। মানুষের রক্তই বেশি খায়। এজন্য অবশ্য দূর থেকে বা অন্ধকারে মানুষকে খুঁজে পাওয়ার জন্য কিছু বাড়তি ক্ষমতা রয়েছে স্ত্রী মশাদের। মানুষের দেহের তাপ, ঘাম এবং নিঃশ্বাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে এরা ক্লু হিসেবে ব্যবহার করে। এসব শনাক্তের জন্য মশাদের রয়েছে সংবেদনশীল শুঁড় বা অ্যান্টেনা। শুঁড় বা অ্যান্টেনাতে মশাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়, তাপ ইন্দ্রীয়, শ্রবণ ইন্দ্রিয় ইত্যাদি থাকে।

অ্যান্টেনা ছাড়াও চোখ ব্যবহার করতেও তো নিষেধ নেই মশাদের। দিব্যি দু জোড়া পুঞ্জাক্ষী রয়েছে। অর্থাৎ ঘ্রাণ, তাপ ও শ্রবণ ইন্দ্রিয় ছাড়াও মশারা চোখে দেখেও মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, মশার অ্যান্টেনাতে বিশেষ একধরনের অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টর (ঘ্রানের সংবেদন) রয়েছে। যা দিয়ে মশা ঘামের রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করে মানুষকে সহজেই খুঁজে পায়। মশা বিশেষ অনুভুতির মাধ্যমে মানুষের ঘামের গন্ধ বুঝতে পারে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন, কীভাবে মানুষের ঘামের গন্ধ কীভাবে শনাক্ত করে। মানুষের ঘামের আছে ল্যাকটিক অ্যাসিডসহ বেশকিছু উদ্বায়ী অ্যাসিডিক উপাদান। এগুলোর গন্ধে মশা আকৃষ্ট হয় এবং রক্তের সন্ধান করে।

উনিশ শ ষাটের দশকে বিজ্ঞানীরা শুধু জানতেন, মানুষের দেহের ঘাম এবং নিঃসৃত ল্যাকটিক অ্যাসিড মশাকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু কিভাবে এগুলি মশার দেহে সংবেদনশীল হয়, তা কারো জানা ছিল না। প্রায় চার দশক ধরে ধরে বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াটির সন্ধান করেছেন। এটা জানা ছিল, মশার দেহের অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টর বা ঘ্রাণের সংবেদনে এমন কিছু আছে, যা মানুষের ঘামের গন্ধের মাধ্যমে মানুষের উপস্থিতি বুঝতে সক্ষম হয়। সৌভাগ্যক্রমে, বিজ্ঞানীরা মশার দেহের এই বিশেষ অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টরটি শনাক্ত করে ফেলেছেন। যা মানুষের ঘামের গন্ধ চিহ্নিত করতে দায়ী। এই রিসেপ্টরটি আয়োনোট্রপিক রিসেপ্টর (IR8a) নামে পরিচিত।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের ঘামে থাকা অ্যাসিডিক অ্যাসিড হচ্ছে আসল ক্লু। এর মাধ্যমেই মশা মানুষকে খুঁজে পায়। যদিও বলা হয় যে, মশা মানুষকে টার্গেট করতে একাধিক ক্লুর উপর নির্ভর করে। মশা ত্রিশ ফুটের বেশি দূর থেকে বুঝতে পারে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় নিঃসৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অস্তিত্ব। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাধ্যমে মশা মানুষের শরীরের গন্ধ বুঝতে শুরু করে। মশা এই গন্ধ অনুসরণ করে এবং খুব কাছাকাছি এলে মানুষের শরীরের তাপও শনাক্ত করতে পারে।

এরপর মশা মানুষের শরীরে বসে, চামড়ার ওপরে একটি উপযুক্ত স্থান বাছাই করে এবং বিশেষ শুঁঙ্গ ঢুকিয়ে রক্ত শুষে নেয়।সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ক্রিসপার/কাস-৯ জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন মশার দেহে। এর সাহায্যে তাঁরা আয়োনোট্রপিক রিসেপ্টর জিনকে সরিয়ে মিউট্যন্ট মশা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আয়োনোট্রপিক রিসেপ্টর জিনের অনুপস্থিতিতে মশা তাদের আচরণ পরিবর্তন করে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা জেনেটিকভাবে এই নির্দিষ্ট ঘ্রান শনাক্তকারী জিনের কার্যক্ষমতা রোধ করতে মশার দেহে এই পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, মিউট্যান্ট মশা ল্যাকটিক অ্যাসিডের প্রতি আর আকৃষ্ট হচ্ছে না। একইভাবে, মশার এই বিশেষ রিসেপ্টরটি (IR8a) ব্যাহত করলে মশা মানুষের প্রতি কতটা আকৃষ্ট হয়, তা দেখার জন্য বিভিন্ন ল্যাব পরীক্ষা করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা অলফ্যাকোমিটার নামে একটি যন্ত্রে মানুষকে হাত রেখে সেখানে মিউট্যান্ট মশা ও সাধারণ মশা ছেড়ে দিয়ে দেখেছেন। দেখা গেছে, সাধারণ মশার তুলনায় মিউট্যান্ট মশারা মানুষকে খুব কম আকর্ষণ করেছিল।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়লো ফিভার এবং জিকাসহ বিপজ্জনক এবং মারাত্মক রোগের বাহক হচ্ছে মশা। বিজ্ঞানীরা মশা মানুষকে সনাক্তকরণ ব্যবস্থার এমন কিছু বিষয়ের সন্ধান পেয়েছেন যা দিয়ে একটি শক্তিশালী মশক রিপেলেন্ট (মশাকে দূরে রাখে এমন উপাদান) তৈরি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে রিসেপ্টরের কার্যকারিতা রোধ করার কৌশলটি ব্যবহার করা হবে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মশার দেহে এই রিসেপ্টরের কার্যকারিতা রোধ করলে মশার মানুষকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমে যায়। গবেষণার মুল লক্ষ্য ছিল, এমন একটি স্প্রে বা সুগন্ধি আবিষ্কার করা, যার মাধ্যমেশার কামড় থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়। সুতরাং আমরা এই রকম একটি সুগন্ধির চিন্তা করতেই পারি, যাতে মশা আমাদের (ঘামের গন্ধ) শনাক্ত করতে না পারে এবং কামড়াতেও না পারে।

লেখক: অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ এবং ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট, এনাসটাসিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র