মশা নিধনের একটি পরিকল্পনা

সিডনির এক সংবাদ সংস্থার বরাত দিয়ে আমাদের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি একটা খবর ছাপা হয়েছে। সংবাদটা হলো, বন্ধ্যা পুরুষ প্রক্রিয়ায় এডিস মশা দমন। এর সারসংক্ষেপ হলো: অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদের (সিএসআইআরও) উদ্যোগে জ্যামস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দেখিয়েছেন, পুরুষ এডিস অ্যাজেপ্টাই (Aedes aegypti) কামড়াতে পারে না। শুধু স্ত্রী মশা ডিম দেওয়ার আগে অন্য প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত খায়। পুরুষ এডিস মশাকে বন্ধ্যা করে কুইন্সল্যান্ডের নির্দিষ্ট এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে তিন মাসের মধ্যে তাঁরা ৮০ শতাংশ মশার সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। এই সফল গবেষণায় অর্থায়ন করেছে গুগল অ্যালফাবেট কোম্পানি।

অস্ট্রেলিয়ার মশা নিধনের এই চমকপ্রদ সফলতাকে কেন্দ্র করে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেশে এর প্রয়োগের একটা খসড়া ‘গবেষণা প্রকল্প’ সাজানোর চেষ্টা করতে চাই। সাধারণভাবে এই প্রকল্পটি ‌‘বন্ধ্যা পুরুষ ছাড়া’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে আমেরিকার কিউরাসিও দ্বীপপুঞ্জে ১৯৫৯ সালে গবাদিপশুর ক্ষতিকর মাছি স্ক্রু্ওয়ার্ম ফ্লাই দমনে সফল হয়েছিল। পরে পৃথিবীর অনেক দেশে বিভিন্ন জাতের ফলের মাছি, সেটসি ফ্লাইয়ের ওপর এলাকাভিত্তিক এই প্রক্রিয়া সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর আমাদের দেশে ১৯৮২ সাল থেকে আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাভারে আমরা ছোট আকারে স্থানীয় ফলের মাছির ওপর এই প্রক্রিয়াটা ট্রায়াল দেওয়া শুরু করি। সেসব প্রজেক্ট এখনো চলছে।

আমরা জানি, এডিস মশা ডেঙ্গু, জিকা ও চিকনগুনিয়ার মতো ভয়াবহ রোগ ছড়ায়। সুতরাং প্রকল্পের লক্ষ্য এদের সংখ্যা কমানো ও বাধা দেওয়া, যাতে এগুলো ছড়াতে না পারে এবং সংখ্যায় কমে আসে। এর পদ্ধতিগত মূলমন্ত্রণা হল বন্ধ্যা পুরুষ মশার সঙ্গে প্রাকৃতিক স্বাভাবিক স্ত্রী মশার মিলনে যে ডিম হবে তা ফুটে কোন মশা জন্মাবে না।

মশা নিধনের এমন প্রকল্প পরিকল্পনা করতে গেলে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

ক. শনাক্তকরণ অর্থাৎ কীটপতঙ্গ শনাক্তকরণের আন্তর্জাতিক চাবির (Key) সাহায্যে এডিস অ্যাজিপ্টাই চেনার সঠিক ও সহজ উপায় বের করতে হবে। এখানে পুরুষ মশাকে স্ত্রী মশা থেকে আলাদা করে চিনতে হবে।

খ. টার্গেট মশাটির সহজ প্রতিপালন প্রক্রিয়া (Mass rearing) প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। কেননা, আমাদের অসংখ্য বন্ধ্যা পুরুষ মশা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিপালন ব্যয় কমানোর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।

গ. প্রতিপালিত পুরুষ মশার সংখ্যা কোনো এলাকার প্রাকৃতিক মশার সংখ্যার অনুপাত পরিসংখ্যান সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে। কেননা প্রাকৃতিক মশার দ্বিগুণ বন্ধ্যা মশা ছাড়া দরকার হয়।

ঘ. পুরুষ মশা বন্ধ্যাকরণপদ্ধতির সাধারণ কৌশল হলো গামা রশ্মির ব্যবহার। বর্তমান সময়ের জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা আণবিক রশ্মির পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন ‘ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া’ (Wolbachia Bacteria)। এর ব্যবহারপ্রক্রিয়াও আমাদের ভালোভাবে রপ্ত করতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রযুক্তিগত প্রতিপালন (Rearing) পদ্ধতির শরণাপন্ন হতে হবে। ব্যয়সংকোচনের দিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।

ঙ. বন্ধ্যাকৃত পুরুষ মশা প্রাকৃতিক মশার মতো সবল সক্ষম ও কার্যকর হতে হবে। যেন প্রাকৃতিক মশার তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে। বন্ধ্যা পরীক্ষণ পুরুষকে ছাড়ার আনুমানিক সংখ্যা ও কয়বার ছাড়তে হবে এর একটা যথাযথ প্ল্যান ও অগ্রিম হিসাব থাকতে হবে।

চ. উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলোর (ক-ঙ) সফল প্রয়োগের জন্য মোটামুটি বিজ্ঞানভিত্তিক সুরক্ষিত একটি আলাদা গবেষণাগার থাকা দরকার। কেননা অন্য কোনো কীটপতঙ্গ গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যাতে এদের সংমিশ্রণ না ঘটে। এর সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করতে হবে অণুজীব গবেষণা সেল (cell) দক্ষ ও বিজ্ঞানী ও জনশক্তি।

আমার প্রারম্ভিক বিবেচনায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্প শুরু হতে পারে। কেননা, আমার জানামতে, ঢাকা শহরের ড্রেনগুলোতে ‘গাপ্পি’ নামক ছোট ছোট মাছ ছেড়ে মশার শূককীট দমনের একটি প্রকল্প এ সরকারি সংস্থার রয়েছে।

উল্লেখ, JCU–তে এ সফল প্রকল্পের অর্থায়নে ছিল গুগল অ্যালফাবেট। এ ধরনের বৈজ্ঞানিক অর্থদাতা সংস্থার সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা আমাদেরও রয়েছে। কেননা মশাবাহিত রোগবালাই শুধু নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা এলাকার সমস্যা নয়। বরং এটি পৃথিবীর প্রায় সব এলাকায় মরণব্যাধি হিসেবে বিবেচিত।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন