মশা দিয়ে মশা দমন

জীবজগতে কীটপতঙ্গ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণিগোষ্ঠী। এক হিসাবে দেখা গেছে, সমগ্র প্রাণিজগতের ৭২ শতাংশ কীটপতঙ্গ। দুই মেরু ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্র কীটপতঙ্গের কমবেশি বিস্তার রয়েছে। আবার মেরু অঞ্চলের মানুষ ও বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণী দেহে ক্ষুদ্র আকারের পরজীবী প্রাণী রয়েছে।

প্রজাতি পরিসংখ্যানে এ পর্যন্ত ১০ লাখ কীটপতঙ্গের খবর পাওয়া গেছে। দিনে দিনে এর সংখ্যা আরও বাড়ছে। পৃথিবীতে যত জীবজ একক রয়েছে, এর প্রতিটিই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদের নির্দিষ্ট ভূমিকা ও কার্যকারিতা রয়েছে। এদের ব্যবহারে ও কার্যকারিতায় আমরা নানাভাবে উপকৃত হই। মধু, রেশম, গালা, মোমসহ আরও অনেক অতি মূল্যবান সম্পদ আমরা কীটপতঙ্গের উত্স থেকে পেয়ে থাকি। এ ছাড়া এদের অনেক অপকারী সদস্যকে খেয়ে কীটপতঙ্গ আমাদের কৃষিপণ্য উত্পাদনে সহায়তা দেয়। কীটপতঙ্গের পরাগায়ণের ভূমিকার কথাও সবার জানা আছে নিশ্চয়ই। অন্যদিকে ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েড, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এই মশক জাতীয় পতঙ্গের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মশা। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি যথার্থ উক্তি? বর্তমানে আমাদের দেশেও মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেকটা মহামারির আকার ধারণ করেছে, যাতে আমরা অনেকে আক্রান্ত হয়েছি। একই সূত্রের হিসাবে, গত বছর ৭০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়, এর মধ্যে ৪ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বর্তমান সময়ে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণও বেড়ে চলেছে।

এরই মধ্যে অতি সম্প্রতি আর একটি দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। তা হলো, ম্যালেরিয়া ছড়ানোর একটি সুপার বাগ প্রজাতিগোষ্ঠীর (Super bug strain) আবির্ভাব ঘটেছে, যা ম্যালেরিয়ার জীবাণু ‘প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম’ (Plasmodium falciperum) বহন করে। কিন্তু আশ্বর্যের বিষয় হলো, এই সুপার ম্যালেরিয়া বর্তমানের চিকিত্সাবিদ্যার জানা ওষুধ আর্টিমিজিমিন (Artemmisimim) ও পিপারকুইন (Piperquine) এ ক্ষেত্রে কাজ করছে না। প্রতিরোধের ক্ষমতাসম্পন্ন এই সুপার ম্যালেরিয়া প্রথম আবিষ্কার হয় কাম্বোডিয়ায়। এরপর তা থাইল্যান্ড, লাওস, দক্ষিণ ভিয়েতনাম হয়ে আমাদের দেশের দিকে এগিয়ে আসছে বলে জানা যায়।

এর প্রতিরোধের জন্য অবশ্য একটি টিকার (Vaccine) পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। তবে এসব দুরারোগ্য রোগের বাহক মশা নিয়ন্ত্রণই এর প্রকৃত উদ্যোগ বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এই মূলমন্ত্রণাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডারপা—ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি এডিস মশার বিস্তার দমনে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে এক চুক্তি করেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে কালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দলকে পররাষ্ট্র দপ্তর ১ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে।

এই বিজ্ঞানীরা এখন প্রাথমিকভাবে ‘মশা দিয়ে মশা দমনের কথা’ ভাবছেন। তাঁদের মূল পরিকল্পনা হলো এডিস মশার বংশগতিক কোষের (জিনে) সংশোধন এনে পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত মশা উদ্ভাবন করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া। এই রূপান্তরিত মশা হবে আগ্রাসী এবং নতুন প্রজনন বা জন্ম না দেওয়ার ব্যাপারে বেশি কার্যকর। অর্থাৎ, রূপান্তরিত মশার মাধ্যমে প্রকৃতিতে যে ডিম ও অপরিণত মশা আসবে, তা হবে ক্ষণস্থায়ী। সেগুলো বেশি দিন প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারবে না। এই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক মশার সংখ্যা কমতে থাকবে। বিজ্ঞানীদের আশা, এই পদ্ধতি চালিয়ে যেতে থাকলে ভয়ংকর রূপান্তরিত রোগজীবাণুর বাহক মশাই সামগ্রিকভাবে কমে যাবে। অন্যদিকে রূপান্তরিত ছাড়া মশাগুলোও বেশি দিন বাঁচবে না। এই গবেষণা প্রকল্পের আনুমানিক সময়কাল চার বছর। আর জিন সম্পাদনার কৌশল হিসেবে অনেক বিজ্ঞানী ক্রিসপার ক্যাস৯ (ডিএনএ-কাঁচি) পদ্ধতিকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছেন। এই পদ্ধতি জিন সম্পাদনার সুনির্দিষ্ট সর্বাধুনিক কৌশল। অবশ্য যেকোনো বিজ্ঞান গবেষণা পরিকল্পনার শুরুতে এর অনেক কিছুই অজানা থাকে। ক্রমে ক্রমে তা সংশোধিত ও পরিমার্জিত হতে থাকে।

সার্বিক বিবেচনায় ওপরে উল্লেখিত মশা দমন প্রক্রিয়াটি যে একেবারে নতুন বা মৌলিক, তা নয়। ষাট দশক ও এর পরবর্তী সময়ে উচ্চতর পাঠ্যপুস্তক পর্যায়ে ‘পুরুষ কীটপতঙ্গকে বন্ধ্যা (প্রজনন ক্ষমতাহীন)’ করে প্রকৃতিতে স্বাভাবিক সদস্যদের সংখ্যা কমানো যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

পুরুষ বন্ধ্যা প্রক্রিয়ায় কীটপতঙ্গ দমন বা SIT

এই প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনের গবেষণা ও প্রচলন শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (USDA) উদ্যোগে। তা প্রথমত ফলের মাছির (Fruitfly) ওপর শুরু হলেও পরে তা কিউরাসিও দ্বীপপুঞ্জের গবাদিপশুর স্ক্রু ওয়ার্ম মাছির (ঝপত্বড়িত্স ভষু) দমনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা পায়। এরপর এই পদ্ধতি কীটপতঙ্গ দমন প্রক্রিয়া হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে (১৯৫৪-৫৫)। বন্ধ্যা পুরুষের সাহায্যে পুরো দ্বীপের এই ক্ষতিকর মাছি দমনের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট ব্যয়বহুল। এই প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সহায়তা নেওয়া হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে এই SIT (Sterile male insect pest control) প্রোগ্রাম, যা মূলত একটি বংশগতিক গবেষণাপদ্ধতি (Genetic programme ), বিভিন্ন দেশে কীটপতঙ্গ দমনের ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু হয়।

এই সময়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) ভিয়েনার গবেষণাকেন্দ্রে একই ধরনের কাজ শুরু হয়। সত্তরের দশকে সেখানকার প্রধান গবেষণা প্রকল্পের মধ্যে ছিল ফলের মাছি ((Fruitfly), অন্যটি ছিল সেটসি (Tsetse) মাছি। ফলের মাছির সংক্রমণে পৃথিবীতে ক্ষতির পরিমাণ তখন ছিল ২০ শতাংশের মতো। অন্যদিকে সেটসি মাছির মাধ্যমে রক্তবাহিত অন্ধত্ব রোগ রোধ করা হয়। আমি ১৯৮৭ সালে ওঅঊঅ, ভিয়েনার ফলের মাছি দমন গবেষণার একজন সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম।

আমরা বাংলাদেশের আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BAEC) সাভারেও ১৯৯০ সাল থেকে ফলের মাছি, ডালের মাছি ও শুঁটকি মাছের মাছির ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছি। এসব গবেষণায় আমরা বেশ উত্সাহজনক ফলাফল পেয়েছি। কিন্তু এর জন্য পুরোপুরি এলাকাভিত্তিক সফলতার যে সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনা (Population management), বিশাল অর্থের জোগান, দক্ষ জনবল ইত্যাদির ব্যবস্থা দরকার তা আমরা করতে পারিনি। তবে এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে আমাদের কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপের প্রকল্পটির সাফল্য আশা করা যেতে পারে। ওখানে শুঁটকি মাছের মৌসুমে ভিন্ন প্রজাতির চারটি মাছি ব্যাপক ক্ষতি করে। নষ্ট করে ফেলে শুকাতে দেওয়া শুঁটকি মাছ। সমূলে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও ঝওঞ পদ্ধতির মাধ্যমে মাছ ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট কমানো সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

এই দমননীতির পর্যায়গুলো হলো: ক. প্রকৃতিতে নির্দিষ্ট ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ শনাক্ত করা, খ. গবেষণাগারে সেটিকে প্রতিষ্ঠা করা, গ. এদের প্রতিপালনের জন্য কৃত্রিম খাবার তৈরি করা, ঘ. পুরুষ পতঙ্গগুলোকে বন্ধ্যা করার পদ্ধতি নির্ণয় করা (এ ক্ষেত্রে পতঙ্গের শূককীট পর্যায়ে নিম্নমাত্রায় গামা-রশ্মি (Co60) প্রয়োগ করা হতো। বর্তমানের মশা নিধনের ক্ষেত্রে যে ‘ডিএনএ-কাঁচি’ (ক্রিসপার ক্যাস৯) ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে, তা তখন ভাবাও সম্ভব ছিল না, ঙ. প্রাকৃতিক স্বাভাবিক পতঙ্গের মধ্যে শূককীট অবমুক্তকরণ ইত্যাদি।

সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের মশা দিয়ে মশা দমনের যে পরিকল্পনা, তা তেমন অভিনব কিছু নয়। বরং মোটামুটি তেমন গবেষণা প্রকল্প ষাটের দশক থেকে চলে এসেছে। এমনকি আমাদের মতো বিজ্ঞানে অনুন্নত দেশেও।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী এবং খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়