বন ওকড়া

বনের গাছ বন ওকড়া। অন্য নাম জংলি ঘাগড়া। ইংরেজি নাম অর্মেনিয়া ফাইবার, সিজারউইড ও কঙ্গো জুট। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Urena lobata L. পরিবার মালভেসি। জবা-ঢ্যাঁড়স পরিবারের এই বুনো গাছ রাস্তার ধারে, নদীর পাড়ে, ঝোপঝাড়ে আগাছার মতো জন্মে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এ গাছের দেখা মেলে। না আছে গাছের কোনো কদর, না আছে ফুলের কোনো রূপ। প্রায় সবার কাছেই বুনো ওকড়াগাছ যেন এক বালাই, একবার কোথাও গেড়ে বসলে তাকে উচ্ছেদ করা মুশকিল। অথচ বুনো এই গাছের আছে অনেক ঔষধি গুণ। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বন ওকড়ার ঔষধি গুণ ও রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণের ওপর অনেক গবেষণা হয়েছে ও বিভিন্ন গবেষণাপত্রে সেসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্স ডাইরেক্ট, গুগল রিসার্চ, পাবমেড ইত্যাদি ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেসব তথ্যসূত্রে জানা গেছে, এই গাছে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাভিনয়েড, গ্লাইকোসাইড, টারপিনয়েড ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। এসব রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির কারণে বন ওকড়া জীবাণু রোধকারী, ক্যানসার প্রতিরোধী, অ্যান্টিডায়াবেটিক, অ্যান্টিলিপিডেমিক হিসেবে কাজ করে।

এই গাছ পথ চলতে বনজঙ্গলে ঘুরতে আমাদের অনেকেরই চোখে পড়ে। এমনকি তিলোত্তমা ঢাকা শহরের বুকেও রয়েছে বুনো ওকড়ার উপস্থিতি। জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে শরৎ-হেমন্তের দিনগুলোতে হাঁটতে গিয়ে বহুবার দেখা হয়েছে বন ওকড়ার সঙ্গে। সেই দেখা পত্রপুষ্পশোভিত রূপে। অনেকটা পাটগাছের মতো কাণ্ড বা ডালপালা, কিন্তু পাতাগুলো তুলাগাছের মতো। পাতার কিনারা তিনটি খাঁজে বিভক্ত। ফুল ছোট, পাতার কোল থেকে ফোটে। পাপড়ি পাঁচটি ছড়িয়ে থাকে একটা পিরিচের মতো, হালকা গোলাপি রং, মাঝখানটা একটু গাঢ় লাল, কেন্দ্র থেকে ছোট্ট একটা দণ্ডের মতো উঁকি দেয় জননাঙ্গ।

মৌসুমে গাছে অনেক ফুল ফোটে, ফুলে আসর বসে মৌমাছিদের। সকালবেলা ফুল ফোটে, দুপুরেই ঝিমিয়ে পড়ে। ফলের আকার অনেকটা ছোলাবুটের মতো, কিছুটা গোলাকার, অগ্রভাগে একটা হুকের মতো একটা অঙ্গ থাকে, অনেকটা ঘাগড়া ফলের মতো। এ কারণে ফল কাপড়ে লাগলে আটকে যায়। এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বীজ ছড়িয়ে পড়ে। বীজ থেকে সহজে চারা হয়। কঙ্গো অববাহিকায় এ গাছ বেশি জন্মে বলে এর আরেক নাম কঙ্গো পাট। পাটের মতোই এ গাছ থেকে আঁশ হয়। এ আঁশের উজ্জ্বলতা ও মসৃণতা পাটের চেয়ে বেশি। এমনকি এ গাছের আঁশ উইপোকা ও পানি প্রতিরোধী। আঠারো শতকে অনেক ইউরোপীয় নাবিক এ গাছের আঁশ দিয়ে দড়ি বানিয়ে তা জাহাজে ব্যবহার করতেন। বীজে আছে ৭ শতাংশ তেল, এই ফ্যাট বা তেল থেকে সাবান তৈরি করা যায়।

বন ওকড়াগাছের শিকড়, পাতা ও ফুল বিভিন্ন রোগের চিকিত্সায় প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর শিকড় স্বাদে তেতো ও কটু। শিকড় আন্ত্রিক ক্ষত সারায়, বেটে মলমের মতো ব্রণে লেপে দিলে উপকার হয়। রক্তার্শ সারাতেও এটি ব্যবহার করা হয়। এর পাতা, ফুল ও ফল স্বাদে কইষট্যা ও পিচ্ছিল, অনেকটা জবা ও ঢ্যাঁড়সগাছের পাতার রসের মতো। শিকড় ও পাতার রস পেটের বিভিন্ন অসুখ, বিশেষ করে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে জ্বালাপোড়া নিরাময় করে। এর পাতা ও ফুল কুষ্ঠরোগ চিকিত্সায় ব্যবহার করা হয়। ফুল চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে মেহ রোগের উপশম হয়। বন ওকড়ার ফল খেলে প্রসূতির প্রসববেদনা বাড়ে। পাতা রক্ত পড়া বন্ধ করে ও ক্ষত সারায়। পাতা ও কাণ্ডের ছাল বেটে গরম করে সেঁক দিলে অর্বুদের ফোলা ও জ্বালাপোড়া কমে। বন ওকড়ার ডালপাতা বেটে মলমের মতো করে কপালে লেপ দিলে মাথাব্যথা কমে। পুরো গাছ ছেঁচে তা লাগালে ভাঙা ও মচকা ব্যথা কমে। ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগেও এ গাছের পাতা কার্যকর। পাতা চিবিয়ে তা গোদের ওপর লেপে দিলে ফোলা কমে। এ গাছের ডাল দাঁতনের মতো নিয়ে দাঁত মাজলে বা ব্রাশ করলে দাঁতব্যথা কমে। বাকল ছেঁচে কাটা জায়গায় লাগালে সেসব ক্ষত দ্রুত ভালো হয়ে যায়। শুষ্ক কাশি সারাতে বন ওকড়া ফুলের ক্বাথ বা শরবত কয়েক দিন খেতে হবে। টনসিল ও গলাব্যথায় ফুল পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি দিয়ে গড়গড়া করলে উপকার পাওয়া যায়। কিছু ঝুঁকিও এ গাছের আছে। খুব পুরোনো বা বয়স্ক গাছ টুকরো করে কেটে তা দিয়ে সেদ্ধ করা ডিম গর্ভবতীকে খাওয়ালে তাঁর গর্ভপাত হতে পারে।

এর পাতা গনেরিয়া, ম্যালেরিয়া, জ্বর, ক্ষত, দাঁতব্যথা, বাতব্যথা প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে কাজে লাগে। এ গাছের পাতায় একধরনের আধা পরিশোধিত গ্লাইকোসাইড রয়েছে, যা ব্যথাবেদনা কমাতে সাহায্য করে। এ গাছের পাতার রস পরীক্ষা করে কেম্পেফেরল, কুয়ের্সেটিন ও টিলিরোসাইড নামে তিনটি রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই তিনটি রাসায়নিক উপাদান Escherichia coli, Bacillus subtilis ও Klebsiella pneumonia নামে তিনটি ব্যাকটেরিয়ানাশক হিসেবে কাজ করে। ফলে এসব জীবাণুজনিত সংক্রমণ বন ওকড়াগাছের পাতার রস ব্যবহার করে কমানো যায়। এ ছাড়া পাতায় আছে ১০ রকমের ফ্লাভিনয়েড যৌগ। এগুলো হলো কেম্পেফেরল, কুয়ের্সেটিন, রিউটিন, অ্যাফজেলিন, অ্যাস্ট্রাজিন, টিলিরোসাইড ইত্যাদি। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা পাতা বিশ্লেষণ করে যেসব উপাদান পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো জলীয় অংশ বা পানি ৮১ দশমিক ৮ শতাংশ, ৩ দশমিক ২ প্রোটিন, ১২ দশমিক ৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১ দশমিক ৮ গ্রাম খাদ্য আঁশ, ৫৫৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ৬৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস। এসব উপাদান থাকায় আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে বন ওকড়ার কচি পাতা শাক হিসেবে রেঁধে খাওয়া হয়, গরু-মহিষকেও খাওয়ানো হয়। এর পাতা খেলে মহিষের দুধ বাড়ে।

লেখক: উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা