মহাব্যস্ত মতিঝিলের শাপলা চত্বরের কাছের একটি বটগাছে ফলখেকো পাখিদের পাকা বটফল খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। শুরুটা হয়েছে সেই ভোরবেলা থেকে। ভরপেট খেয়ে কেউ গাছ ছাড়ছে, আসছে নতুনরা। এভাবে দিনভর আসা–যাওয়া যেমন চলবে, তেমনি চলবে হুটোপুটি-ঝগড়াঝাটি। এই যেমন এখন একটি নীলগলা বসন্তবাউরির সঙ্গে ঝগড়া লেগেছে একটি স্লিম বডির পাখিরা। পাকা ফলে ভরা একখানা সরু ডালে ঝুলে-দুলে বসন্তবাউরিটি শরীরের পালক ফুলিয়ে আর হাঁ করা মুখ দুলিয়ে দুলিয়ে বলছে, ‘অ্যাই! খবরদার ব্যাটা! এই ডালে এলে খবর আছে!’ এ সময় একজোড়া বুলবুলি ঝড়ের বেগে এসে আক্রমণ করে বসন্তটিকে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসন্তটি দেয় উড়াল-লাফ, কিন্তু পাখিটি এবার বুলবুলি দুটির মুখোমুখি হয়। বুলবুলি দুটি ঝগড়ায় না জড়িয়ে পাকা ফল রেখেই উড়ে যায় অন্য ডালে। পাখিটি এবার খেতে শুরু করে। দুলন্ত-ঝুলন্ত ডালখানা এমনিতেই ফলের ওজনে বেশি ছিল ঝুলন্ত, পাখিটি বসতেই আরও নুইয়ে পড়ে। কিন্তু পাখিটি অনেক পাকা ফল টপাটপ গিলে ফেলে। তারপর একমুখ খাবার নিয়ে দেয় উড়াল। অনেকটা দূরে তার বাসা। একটি পুরোনো দালানের ফোকরে। সেই বাসায় তার ক্ষুধার্ত চারটি ছানা। দিনভর খাইয়েও ছানাদের ‘খাই খাই’ ভাব দূর করা যায় না।
মা পাখি মুখভরা পাকা বটফল নিয়ে ফিরতেই বাসা পাহারায় থাকা বাবা পাখিটি উড়াল দেয়। সে-ও ফিরবে ছানাদের জন্য মুখভরা খাবার নিয়ে। মা পাখি বাবা না ফেরা পর্যন্ত বাসার পাহারায় থাকবে। কেননা, কখনো কখনো মহাধূর্ত পাতিকাকেরা বাসার মুখে ঝুলে বসে চাপা স্বরে এমন শব্দ তোলে যে ছানারা মনে করে, মা বা বাবা এসেছে খাবার মুখে। ফোকরের বাইরে দেয় গলা-মাথা বের করে, অমনি কাকটি কপাত করে ছানাটির মাথা ঠোঁটে চেপে ধরে দেয় উড়াল। ধূর্ত হাঁড়িচাঁচারাও ক্বচিৎ এ রকম কাজ করে। ছানারা যখন কোটর থেকে মুখ বাড়াতে শেখে, বিপদটা তখনই ঘটে বেশি। এই পাখিরা বাসা বানায় বারো মাসই। তবে ভরা মৌসুম বসন্ত থেকে শরত্কাল। গাছের কোটরে, দরদালানের ফাঁকফোকরে ও ভেন্টিলেটরের ভেতর সরু ঘাস-লতা-শিকড়-পালক-কাগজ ইত্যাদি এনে বাসা সাজিয়ে মেয়ে পাখিটি ডিম পাড়ে চার–পাঁচটি। অনেকটা গোলাপি-সাদাটে রং ডিমের। বাসা যেমন দুজনে মিলে গড়ে, তেমনি দুজন মিলে পালা করে তা দিয়ে ১৫ থেকে ২১ দিনে ছানা ফোটায়। তবে শহরে বা গ্রামের স্টিলের বিদ্যুৎ পোলের ফোকরে বাসা করে সুযোগ থাকলে। খোদ রাজধানী ঢাকার কয়েকটি পয়েন্টে এমন বাসা আজও দেখা যাবে। ১৯৭৪ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত আমি ৫৪, পুরানা পল্টনের হলুদ পাঁচতলা ভবনটিতে অফিস করেছি (ওটা এখন নেই, সেখানে এখন নতুন ভবন, বায়তুল মোকাররম মসজিদের ঠিক উত্তর পাশে, রাস্তার ওপারে)। ওটি ছিল পুরোনো আমলের দালান, ৫৫টি বড় বড় ভেন্টিলেটর ছিল, প্রতিবছরই তিন–চারটি ভেন্টিলেটরে বাসা করত এই পাখিরা, অন্যগুলো বারো মাসই দখলে রাখত আবাবিল পাখিরা (House swift)।
এই পাখিরা আছে সারা বাংলাদেশে। এরা ডালপালা বেয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সুড়সুড় করে চলাচল করতে পারে, গাছের ডাল-পাতার সঙ্গে ক্যামোফ্লেজ হয়ে থাকতে পারে। কেননা, এদের শরীরের উপরিভাগ চকচকে ধূসর, মাথাটা সাদাটে ধূসর বা বাদামি, গলা-বুক–পেট গাঢ় বাদামি, তার ওপরে খয়েরি অস্পষ্ট আভা, লেজের তলা খয়েরি, চোখের রিংটা হলুদ, ঠোঁট ও পা হলুদ। এরা জোড়ায় চলে, প্রয়োজনে ঝাঁকবদ্ধ হয়। নিরীহ পাখি। চঞ্চল-চতুর ও হুঁশিয়ার এই পাখিদের নাম কাঠশালিক। বাগেরহাট অঞ্চলে পরিচিত বাইনেবউ নামে। ইংরেজি নাম Chestnut tailed starling. বৈজ্ঞানিক নাম Sturnia malabarica. দৈর্ঘ্য ২১ সেন্টিমিটার। ওজন ৪০ গ্রাম। এদের মূল খাদ্য নানা রকম পোকামাকড়, শস্যদানা, ছোট ছোট ফল, ফুলের মধু–রেণু। বিশেষ করে অশ্বত্থের ফল, ডুমুর, পাকা খেজুর, পাকুড়, উড়ে আমের ফল ও বলাফল বেশি প্রিয়। তবে সুযোগ পেলে মাটিতে নেমে মানুষের ফেলে দেওয়া ভাত, রুিট-বিস্কুটের টুকরো, চিনাবাদাম ইত্যাদি খায়। তাল-খেজুরের রস পান করে এরা নিয়মিত। বাল্য-কৈশোরে আমরা সুতোর ফাঁস-ফাঁদ পেতে অন্য রসখেকো পাখিদের সঙ্গে কাঠশালিকও আটকাতাম। এ ধরনের স্মৃতি বাংলাদেশের বহু প্রবীণেরই আছে। আজও দেশের নানা প্রান্তে জাল-ফাঁদে আটকে এসব পাখি ডজন বা হালি হিসাবে বিক্রি করতে দেখা যায়। এটা আইনত দণ্ডনীয়। ২০ থেকে ৩০ বছর আগেও রাজধানী ঢাকা ও শহরতলিতে কিছু খেজুরগাছে রসের ঠিলা-কলস দেখা যেত, দেখা মিলত খেজুরের নলিতে কাঠশালিকেরও। গাছের সরু ডালডালা-পাতা ও কাণ্ড বেয়ে এরা দ্রুত উঠতে-নামতে পারে সার্কাসম্যানদের মতো। গাছের ডালপালা পায়ে আঁকড়ে একেবারে উল্টো হয়েও ঝুলতে-দুলতে পারে। রাজধানীতে কাঠশালিক যথেষ্টই আছে। পার্ক-উদ্যানে গিয়ে দেখা না মিললেও শোনা যেতে পারে এদের মিষ্টি-মোলায়েম ডাক।
লেখক: পাখিবিশারদ