গানের পাখি মৌটুসি

বইছে ফুরফুরে ফাল্গুনী হাওয়া, প্রকৃতি সেজেছে বাসন্তী রঙে, ফুটেছে নানা ফুল। চরাচরজুড়ে বাসন্তী সুঘ্রাণ যেন ছড়াচ্ছে। সোনালু, দেবদারু, অশ্বত্থ, গাবগাছেই ঢেউ বইছে উজ্জ্বল তামাটে রঙের—পাতায় পাতায় নাচছে বসন্তের বাতাস! চমত্কার পত্রসংগীত! পাখিরাও মেতেছে যেন বাসন্তী উত্সবে, চলছে গান ও নাচ। ওদের জীবনেও এসে গেছে বসন্ত—ম ম প্রেমে এখন মশগুল ওরা। সামনেই বাসা বাঁধার দিন আসছে। বাসা হবে, ডিম হবে, সেই ডিম ফুটে কী সুন্দর ছানা যে হবে! এই এখন যেমন সুন্দর ছোট দুটি পাখি উড়ে চলেছে বাসার উপকরণের খোঁজে। পুরুষটি আনন্দে ধাতব সুরেলা ও মিষ্টি গলায় ‘ঠুইসিসি সিট, সিট সিট সিইটি’ বলে গান গাইছে।

বাসা বাঁধার সময় সারাক্ষণই পুরুষটি মেয়েটির পাশে পাশে থাকবে। অবশ্য বছরের অন্য মৌসুম ছাড়াও ওরা সর্বক্ষণ জোড়ায় জোড়ায় চলে। নৃত্যগীত ও ফুর্তিতে পুরুষটিই পারঙ্গম বেশি। প্রজনন মৌসুমে গাছের ডালে বা নারকেলগাছের মাথায় বসে (নারকেল ফুলের মধুরেণু খুবই প্রিয় পানীয় এদের) গান গাইবে আর লম্ফঝম্প করবে। এই এখন যেমন উড়ে চলেছে দুটিতে—কোথায় যাবে, তা মেয়েটিই জানে। পুরুষ গেয়ে চলেছে ‘বাসা বাঁধার গান’।

মেয়ে পাখিটি এক গেরস্ত বাড়িতে এল। খড়ের চালার তলায় হোভারিং করে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ঠোঁটে সংগ্রহ করল ঝুল, ডিমের খোসাসহ মাকড়সার জাল, তারপর দিল উড়াল। অমনি নৃত্যগীতরত পুরুষটি লেবুগাছের ডাল ছেড়ে বউয়ের পিছু নিল।

মেয়েটি অর্ধসমাপ্ত ঝুলন্ত বাসাটির গায়ে উপকরণগুলো খুব হিসাব-কিতাব করে বাসাটা জুড়ল সরু ও নিম্নমুখী বক্র সুই ঠোঁট দিয়ে, তারপর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল বাসাটার অবয়ব, তারপর আবারও উড়াল—উপকরণের খোঁজে। পাশাপাখি চলেছে পুরুষটিও, চলছে গান। এই পাখিদের গানের শব্দ শুনে যেমন চলাচলের পথটা বোঝা যায়—খোঁজ পাওয়া যায় বাসাটারও। পুরুষটি মহা ফুর্তিবাজ পাখি। কাজের কাজ সে কিছুই করে না—গান গায় আর বউয়ের পাশে থাকে, উত্সাহ দেয়, ওড়ে। বাসা বাঁধার গাছের দুলন্ত-ঝুলন্ত আনুভূমিক সরু ডাল নির্বাচন মেয়েটিই করে—বাসাও তাকে বাঁধতে হয় একাই। বাসাটা দেখতে হয় শিল্পীর গড়া ঝুলন্ত লম্বাটে থলের মতো, বাসার প্রবেশমুখের ওপর কার্নিশ বা শেড থাকে। বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচনে তিন–চার দিন লাগে। চমত্কার-শিল্পিত দৃষ্টিনন্দন খাসা বাসাটি সম্পন্ন করতে লাগে ৬ থেকে ৯ দিন। তারপর মেয়েটি ডিম পাড়ে দুটি। বলা যায়, সে একাই ডিমে ১১ থেকে ১৩ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়।

এখানে কথা হচ্ছে, চমত্কার বাসাটার তলদেশে থাকে মখমলের মতো আরামদায়ক গদি, সেই গদিতে বসে আর লম্বা-বক্র ঠোঁটটি বাসার দরজাপথে বেরিয়ে দিয়ে মেয়েটি যখন ডিমে তা দেয়, তখন বাতাসে ঝুলন্ত-দুলন্ত ডালের দুলুনিতে মেয়েটি কী সুখকর ঘুম ঘুম দুলুনি যে খায়! সাদা সাদা ঘাসফুল-শিমুল তুলা–পরিত্যক্ত মিহি পাটের আঁশ, সরু শুকনো ঘাস। কলার বাকলের সুতোর মতো আঁশ, মাকড়সার ডিমের খোসাসহ জাল ইত্যাদি হলো বাসার প্রধান উপকরণ। এই পাখিদের বাসা বানানোর শৈল্পিক কৌশল দেখার জন্য আমি স্কুল কামাই করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রয়েছি। নেশা ছিল। আমার তো বিশ্বাস, মেয়েটিকে আনতে হয় হাজারটা উপকরণ। তাই তাকে যাতায়াত করতেও হয় হাজারবার। খুবই কষ্টকর কাজ। এখানে উল্লেখযোখ্য যে আমি বেশ কবার দেখেছি, বাসা বানানোর জন্য ভুল জায়গা (যেমন পেঁপেপাতা-কলাপাতা) নির্বাচন করে এরা পণ্ডশ্রম করছে। এ রকমটি ঘটে জীবনের প্রথম বাসাটি বানানোর সময়। এদের বাসা বাঁধার মৌসুম শীতের শেষ থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত।

পাখিটির নাম মৌটুসি। আরেক নাম ফুলটুনি। ফুলের মতোই সুন্দর। ঢাকা শহরেও বাসা করে এরা—আছে স্থায়ীভাবে সেই কতকাল ধরে! আবাসিক এলাকার ফুল গাছসহ অন্যান্য গাছে ও পার্ক-উদ্যানে বাসা করে। দেখা মেলে সারা বাংলাদেশে। এখনো গ্রামে গেলে আমি ওদের গান শুনে বাসা খুঁজে পাই। ইংরেজি নাম পুর্পলে–রামপেড সানবার্ড। বৈজ্ঞানিক নাম Leptocoma zeylonica। দৈর্ঘ্য ১০ সেমি। ওজন ৯ গ্রাম। পুরুষটির বুক ও পেটের উপরিভাগ টকটকে হলুদ, ঘন বেগুনি বুকের উপরিভাগ ও গলা, মাথা চকচকে মেরুন রঙা, পাখা ও লেজ কালো। লেজের গোড়ার উপরিভাগটা ভেলভেটি বেগুনি। নিম্নমুখী বক্র ঠোঁটটি কালো। পা–ও কালো। মেয়েটির ঘাড়-মাথা-পিঠ চকচকে জলপাই-বাদামি। ডানায় লালছে আভা মাখানো। ধূসর গলার নিচের বুকটা হলুদ। পেট সাদাটে। মূল খাদ্য এদের ফুলের মধুরেণু তথা নির্যাস ও অতি ক্ষুদ্র পোকামাকড়সহ তাল-খেজুরের রস। জবা–জাতীয় ফুলের সামনে হোভারিং করে যখন লম্বা ঠোঁটটি ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে মধুরেণু পানের সময় স্থির থাকে শূন্যে, তখন দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সে বড় নান্দনিক, শিল্পিত সৌন্দর্য!

লেখক: পাখিবিশারদ