জেনেটিক তথ্য অনুলিপি হওয়ার প্রক্রিয়াটি নিখুঁত নয়। মিউটেশন নামের ভুল সেখানে প্রায়ই ঘটে। এসব মিউটেশনের মধ্যে বেশির ভাগই কোনো কাজের নয়, ভাইরাসের কোনো সুবিধাও হয় না, অসুবিধাও হয় না। কিছু মিউটেশন ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। সেগুলো শনাক্ত করা খুব কঠিন। কেননা, সেই মিউটেশনধারী ভাইরাস তার পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যেতে পারে না। ফলে ছড়ায় না। আর অল্প কিছু মিউটেশন রয়েছে, যেগুলো ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই সেগুলোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা তা শনাক্ত করতে পারি। তাই বলা যায়, ভাইরাস বেছে বেছে অধিক সংক্রমণক্ষম মিউটেশন ঘটায় না; বরং র্যান্ডমভাবে হতে থাকা মিউটেশনগুলোর মধ্যে যেগুলো অধিকহারে সংক্রমণ ঘটায়, সেগুলোই বেশি বেশি পাওয়া যায়। সেই প্রকরণগুলো বেশি করে শনাক্ত হয়। এর নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন। কিন্তু আমাদের শরীরও বসে থাকে না। সেখানেও একধরনের নির্বাচন প্রক্রিয়া চলমান। কীভাবে, তা জানতে হলে পড়তে থাকুন।
বাইরের কোনো জিনিস (অ্যান্টিজেন) দেহের মধ্যে অনুপ্রবেশ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি নামের বিশেষ একশ্রেণির প্রোটিন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করতে থাকে। অ্যান্টিজেনের সঙ্গে অ্যান্টিবডির সম্পর্ক অনেকটা তালা-চাবির মতো। যেকোনো অ্যান্টিজেনের (যেমন স্পাইক প্রোটিন) আণুবীক্ষণিক ত্রিমাত্রিক গঠনের সাপেক্ষে তার বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। একই অ্যান্টিজেনের ভিন্ন আকারবিশিষ্ট অংশগুলোকে বলে এপিটোপ। কোনো একটি এপিটোপের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এমন কোনো অ্যান্টিবডি সেই একই অ্যান্টিজেনের ভিন্ন কোনো এপিটোপের সঙ্গে বন্ধন না–ও করতে পারে। এ জন্য সংক্রমণ বা টিকার প্রতিক্রিয়ায় কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে কেবল এক প্রকারের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না, বরং এক সেট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যার প্রতিটি কোনো না কোনো এপিটোপের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত হতে পারে। সে হিসেবে প্রতিটি অ্যান্টিজেন হলো এক সেট তালার (অর্থাৎ এপিটোপ) সমষ্টি, যার প্রতিটির জন্য কমপক্ষে একটি করে চাবি (অর্থাৎ অ্যান্টিবডি) তৈরি হয়। স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে এ রকম যত প্রকারের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তার সব কটি সংক্রমণ ঠেকাতে সমান কার্যকর নয়।
রোগজীবাণু কিংবা ক্ষতিকারক জিনিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেহে দুই ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা (Immune system) রয়েছে—সহজাত (innate) এবং অভিযোজনমূলক বা অর্জিত (Adaptive/Acquired)। সহজাত সুরক্ষা অনেকটা মোটাদাগের ব্যবস্থা, সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিটি হুমকির মোকাবিলা আলাদা উপায়ে না করে সেটা অনেকটা একই ধাঁচে কাজ করতে থাকে। যেমন একটা নির্দিষ্ট আকারের থেকে বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত গৎবাঁধা নকশাওয়ালা কোনো অণু বা অণুসমষ্টি পেলেই ডেনড্রাইটিক কোষ (কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ম্যাক্রোফেজ বা অনুরূপ অন্য কোনো কোষ) তা কোষভক্ষণ (Phagocytosis) প্রক্রিয়ায় খেয়ে হজম করে ফেলে। সেই বস্তু আসলে কিসের এবং কী ধরনের ঝুঁকি তার থাকতে পারে অথবা আদৌ সেটা খাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না কিংবা কীভাবে তা ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়—এত সব বাছবিচার করে না।
অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষায়িত সমাধান দেয় অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা। প্রায় ৪০ কোটি বছর আগে কনড্রিকথিস শ্রেণিভুক্ত (অর্থাৎ হাঙর, করাতমাছ প্রভৃতি চোয়ালবিশিষ্ট তরুণাস্থিময় মাছ) জীবে প্রথম উদ্ভূত এই ব্যবস্থা কিন্তু আগে থেকে থাকা সহজাত সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। যেমন ডেনড্রাইটিক কোষ যখন কোনো কিছু খেয়ে হজম করে, তারপর সেই জিনিসের ছোট ছোট টুকরো (Antigen) তার নিজের কোষঝিল্লির বাইরের দিকে লাগিয়ে রেখে একরকমের প্রদর্শনী করতে থাকে। একে বলে অ্যান্টিজেন উপস্থাপন (Antigen presentation)। অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোষ, যেমন লিম্ফোসাইট সেই উপস্থাপিত টুকরোর সঙ্গে নিজের কোষঝিল্লির বিশেষ প্রোটিনের সংযোগ স্থাপন করতে পারলে উদ্দীপ্ত হয় এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেই টুকরোর আসল বাহকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে পারে। আমাদের দেহের অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা এ রকম প্রায় ১ থেকে ১০ কোটি (107-108) প্রকারের ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিজেন আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে। সেগুলোর প্রতিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে পৃথকভাবে। প্রত্যেক প্রকার অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে হলে কমপক্ষে তত প্রকার প্রোটিন দরকার। আর প্রত্যেক প্রকার প্রোটিন তৈরির সংকেত দেওয়ার জন্য দরকার কমপক্ষে একটি করে জিন। কিন্তু মানুষের জিনের সংখ্যা তো সর্বসাকল্যে বিশ হাজারের মতো!
এ সমস্যার সমাধান বের করে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পান জাপানের সুসুমু তোনেগাওয়া। তিনি দেখান, গুটিকয় জিন নিজেদের মধ্যে বিন্যাস সমাবেশ ঘটিয়ে লক্ষকোটি ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরির সংকেত দিতে পারে। অর্জিত সুরক্ষার অন্যতম কোষ লিম্ফোসাইটগুলো যখন কেবল জন্মায়, তখন সেগুলোর মধ্যে উল্লিখিত জিনগুলোর ওলট–পালট ঘটে অনেকটা র্যান্ডমভাবে। তাই কোনো একটি বিশেষ অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর মতো প্রোটিন তৈরি হয় মাত্র গুটিকয় (10-1000) লিম্ফোসাইটের মধ্যে। বি-লিম্ফোসাইট ও টি-লিম্ফোসাইটের ক্ষেত্রে সেই প্রোটিনকে যথাক্রমে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) বলে। এ রকম হতে পারে যে হয়তো সেই অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে জীবনে কখনোই আসা হলো না কিংবা প্রকৃতিতে হয়তো সেই অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মতো অ্যান্টিজেনই নেই। কিন্তু যদি এমন কোনো অ্যান্টিজেন দেহে ঢোকে, যেটা লিম্ফোসাইটের সিলেবাসে ‘কমন’ পড়েছে, অর্থাৎ লক্ষাধিক প্রকারের অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের মধ্যে কোনো একটির সঙ্গে তা সুনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাহলে সেই বিশেষ প্রোটিন ধারণকারী গুটিকয় লিম্ফোসাইট সাঁই সাঁই করে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে এবং ওই অ্যান্টিজেন ও তার বাহককে আক্রমণ করতে থাকে। এই পর্যায়ে লিম্ফোসাইটগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচন চলতে থাকে। যে লিম্ফোসাইটের সুরক্ষা-প্রোটিন (অ্যান্টিবডি বা টিসিআর) উল্লিখিত অ্যান্টিজেনের সঙ্গে যত ভালোভাবে বন্ধন তৈরি করতে পারে, সেটির টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি হয়। তার সংখ্যাবৃদ্ধির হারও তত বেশি। লিম্ফোসাইটের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু জিনে উচ্চহারে মিউটেশন হয়। তার অনেকগুলোরই কোনো প্রভাব নেই, আর কোনো কোনো মিউটেশন লিম্ফোসাইটের টিকে থাকার পক্ষে সমস্যাজনক। তবে গুটিকয় লিম্ফোসাইটে এমন কিছু র্যান্ডম মিউটেশন হয় যে সেগুলো অ্যান্টিজেনকে প্রতিহত করতে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ বনে যায়। সেগুলোর সংখ্যাই তখন অনেক বেশি হারে বাড়ে। তার মধ্যে কিছু লিম্ফোসাইট তখনই সরাসরি আক্রমণে না গিয়ে অস্থিমজ্জাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। এগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলাতক সৈনিক ভাবলে ভুল করবেন। এগুলোর অপর নাম মেমোরি সেল। এ নিয়ে একটু পরে বিস্তারিত বলব।
সুরক্ষাব্যবস্থার কোষগুলো যখন সরাসরি ভাইরাসে আক্রান্ত কোষকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে, সেটা কোষীয় সুরক্ষা বা সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি। আর অ্যান্টিবডি (এবং আরও কিছু প্রোটিন) নিঃসরণ করার মাধ্যমে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থাটির নাম রসীয় সুরক্ষা বা হিউমোরাল ইমিউনিটি। আর একই সঙ্গে সুরক্ষাব্যবস্থার কোষগুলো থেকে নিঃসৃত হতে থাকে সাইটোকাইনসহ বিভিন্ন প্রকারের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, যেগুলো ভাইরাস ধারণকারী কোষকে ধ্বংস করা, আক্রান্ত অংশে রক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে রোগটি নির্মূল করার ক্ষমতা রাখে। টিকার অ্যান্টিজেন এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে তা সত্যিকারের জীবাণু হানা দেওয়ার আগেই অভিযোজনমূলক সুরক্ষাব্যবস্থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
সুরক্ষাব্যবস্থার কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করতে অবশ্য কেবল অ্যান্টিজেনই যথেষ্ট নয়। কেননা, প্রকৃতির বহু অ্যান্টিজেনের সঙ্গে শরীরের নিজস্ব উপাদানের কাকতালীয় গাঠনিক সাদৃশ্য থাকতে পারে। সম্ভাবনাটি খুব কম নয়। তখন উদ্দীপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা নিজের দেহকে শত্রু ভেবে আক্রমণ করতে পারে। আত্মঘাতী গোল করার মতো এ রকম ঘটনা সত্যিই ঘটে। তখন তাকে বলে অটো ইমিউন অসুখ। জীবের টিকে থাকার জন্য এটা বেশ অসুবিধাজনক। তাই কো-স্টিমুলেশন নামের একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা জীবদেহে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে, যেটা এ রকম সমস্যা অনেকটা ঠেকাতে পারে। যখন জীবকোষ ও টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তার ধ্বংসাবশেষ দ্বারা কো-স্টিমুলেশন ঘটে। ঠিক একই সময়ে একই সঙ্গে যদি সুরক্ষাব্যবস্থার জালে অ্যান্টিজেন ধরা পড়ে, তখন সেই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি, টি-সেল ইত্যাদি সুনির্দিষ্টভাবে উৎপাদিত হতে থাকে। এতে করে ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।
টিকায় কাঙ্ক্ষিত অ্যান্টিজেন থাকলেও সেটা যেহেতু সরাসরি দেহের কোষকলার ক্ষতি করে না, সেহেতু কো-স্টিমুলেশন হয় না। তাই দেহের সুরক্ষাব্যবস্থা যাতে উদ্দীপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়, সে জন্য টিকায় মূল উপাদানের পাশাপাশি কো-স্টিমুলেশন তৈরি করতে পারে, এমন কিছু জিনিস যোগ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন টিকায় বিভিন্নভাবে কাজটি করা হয়, যেখানে যেটা সবচেয়ে ভালো কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্তত ৬-৭ প্রকারের করোনা টিকা বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও প্রয়োগের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে দুই প্রকারের টিকা নিয়ে সর্বাধিক আলোচনা হচ্ছে। এম-আরএনএ-ভিত্তিক টিকা (যেমন ফাইজার ও মডার্না) অ্যান্টিবডি উৎপাদনে বেশ পারদর্শী। আবার ভাইরাল ভেক্টর টিকা (যেমন অক্সফোর্ড ও জনসন) টি-সেল উদ্দীপ্ত করতে অধিক করিতকর্মা। এগুলোর কাজের ধরনের সঙ্গে মিল রেখে কো-স্টিমুলেশন সৃষ্টিকারী উপাদান ভিন্ন হতে পারে।
ভাইরাসবাহক (Viral vector) টিকার বাইরের খোলসটা কোনো কম ক্ষতিকারক বা নির্দোষ প্রজাতির ভাইরাসের (যেমন অ্যাডিনোভাইরাস) থেকে নেওয়া কিন্তু ভেতরে থাকে টার্গেট ভাইরাসের (এ ক্ষেত্রে SARS-CoV-2) জিনোম বা তার অংশ (যেমন স্পাইক প্রোটিন)। জিনোমটাকে এমনভাবে পাল্টে দেওয়া হয়, যাতে এই হাইব্রিড ভাইরাস নিজে বংশবৃদ্ধি করতে না পারে (সংখ্যাস্থিতক বা নন-রেপ্লিকেটিং) কিংবা করলেও তা বিপজ্জনক মাত্রায় না হয় (সংখ্যাবর্ধক বা রেপ্লিকেটিং)। এই টিকা প্রয়োগ করার পর সেটা অন্য যেকোনো ভাইরাসের মতোই কোষঝিল্লির রিসেপ্টরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জেনেটিক বস্তুটিকে কোষের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। তখন সেই জেনেটিক বস্তু থেকে ভাইরাসের কলকবজা তৈরি হয় এবং সুরক্ষাব্যবস্থা সেই অংশগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে।
এম-আরএনএ টিকার ক্ষেত্রে সরাসরি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক কোড অনুসারে নির্মিত মেসেঞ্জার আরএনএর (সংক্ষেপে এম-আরএনএ) টুকরো দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। সেটি কোষে ঢুকে কোষের নিজস্ব প্রোটিন উৎপাদনব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ভাইরাসের সংশ্লিষ্ট অংশ বা প্রোটিন তৈরি করে। ভাইরাল ভেক্টর টিকার মতো এটিও তখন সুরক্ষাব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করতে পারে।
এই দুই প্রকারের টিকার মিশ্র ডোজ নিলে কী হয়, তা নিয়ে এই লেখা পর্যন্ত সীমিত আকারে গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে একটি যদি অক্সফোর্ড এবং অপরটি যদি ফাইজারের হয়, তাহলে এক ডোজের তুলনায় তা অনেক বেশি কার্যকর। কোনটা আগে কোনটা পরে নেওয়া হলো, তাতে কিছু আসে যায় না। তবে দুই ডোজ ফাইজার কিংবা দুই ডোজ অক্সফোর্ডের বিপরীতে এদের মিশ্র ডোজের প্রভাব কেমন, তা এখনো জানা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত সব কোভিড টিকা করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো উপায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তবে এক উৎপাদকের থেকে এ ক্ষেত্রে অন্য উৎপাদকের বেশ কিছু পার্থক্য আছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া বা টিকার মূল উপাদান–সম্পর্কিত (প্রোটিন, নাকি ডিএনএ, নাকি আরএনএ, নাকি দুর্বল ভাইরাস) পার্থক্য তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে কোন এপিটোপের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, সেটার পার্থক্য। আরও পার্থক্য আছে কো-স্টিমুলেশনে ব্যবহৃত উপাদানে। টিকার ফর্মুলা স্থিতিশীল রাখার জন্য যেসব রাসায়নিক যোগ করা হয়, সেগুলোরও পার্থক্য আছে। মিশ্র ডোজের ক্ষেত্রে এগুলোর সমন্বয়ে শরীরে কেমন প্রভাব পড়বে, তা নিবিড়ভাবে গবেষণা না করে বলা সম্ভব নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিশ্র ডোজের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছে। কিন্তু কোনো একটি উৎপাদকের তৈরি টিকার সংকট হওয়ার কারণে সেই একই ব্র্যান্ডের আশায় দ্বিতীয় ডোজ না নিয়ে বসে থাকার চেয়ে অন্য কোনো উৎপাদকের তৈরি টিকা নেওয়া যেতে পারে। সেটা বরং এক ডোজের চেয়ে ভালো।
কোনো টিকা যেভাবেই কাজ করুক না কেন, তা দীর্ঘ মেয়াদে সুরক্ষা দেয় কি না, সেটা নির্ধারিত হয় মেমোরি সেল দ্বারা। মনে আছে সেই লুকিয়ে থাকা প্রশিক্ষিত লিম্ফোসাইটগুলোর কথা? অ্যান্টিজেন দ্বারা অভিযোজনমূলক সুরক্ষাব্যবস্থা একবার উদ্দীপ্ত হওয়ার পর যতবারই সেই অ্যান্টিজেন শরীরে প্রবেশ করুক না কেন, মেমোরি সেল সেগুলোর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। অ্যান্টিজেন শনাক্তকরণ এবং লিম্ফোসাইট প্রশিক্ষণের জন্য তখন আর সময় ব্যয় করতে হয় না। মেমোরি সেলগুলোর সংখ্যা বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে সেগুলো নিঃসরণ করে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি, যা সেই অ্যান্টিজেনের গায়ে সুনির্দিষ্টভাবে আটকে যেতে পারে। অবশ্য একবার তৈরি হওয়ার পর মেমোরি সেলগুলো যদি বহুদিন ধরে অ্যান্টিজেনের দেখা না পায়, তাহলে মেমোরি সেলের সংখ্যা ও কার্যকারিতা কমে যায়। এ জন্য বেশির ভাগ টিকার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডোজ প্রয়োজন হয়। যেসব টিকার এক ডোজই যথেষ্ট (যেমন জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি জেনসেন) বলা হচ্ছে, সেগুলো প্রাথমিকভাবে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সফল হলেও দীর্ঘ মেয়াদে কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যখন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে দ্রুতগতিতে সুরক্ষা দেওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন অবশ্য এক ডোজের টিকা হতে পারে আপৎকালীন বিকল্প। অন্যদিকে দুই ডোজের টিকা (যেমন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা) আজীবন সুরক্ষা দিতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। যদিও এটি কোভিডে আক্রান্ত হওয়া থেকে পুরোপুরি ঠেকাতে পারে না, তবু আক্রান্ত হলেও টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো যে মারাত্মক আকার ধারণ করবে না, তা অনেকখানি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায়। এমনকি করোনাভাইরাসের বিভিন্ন প্রকরণের (যেমন ডেলটা) বিরুদ্ধে অক্সফোর্ডসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত বেশির ভাগ টিকা এখনো যথেষ্ট কার্যকর। কিন্তু টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তি থেকে টিকাবিহীন ব্যক্তিতে ভাইরাসটি সংক্রমিত হলে দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তির মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য টিকা নিলেও মাস্ক পরার অভ্যাস ত্যাগ করা যাবে না। অন্যের ক্ষতির কারণ হওয়া যাবে না। শুধু তা–ই নয়, এভাবে চলতে থাকলে একসময় এমন ভ্যারিয়েন্ট বা প্রকরণ প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়ে যাবে, যার বিরুদ্ধে টিকা একেবারে অকার্যকর। তখন টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিও আর নিরাপদ থাকবেন না। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবীর সিংহভাগ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিতে হবে। লক্ষ করুন, বেশির ভাগ নাগরিককে টিকার আওতায় আনার পরও কোনো কোনো দেশে কোভিড আক্রান্তের হার এখনো কমছে না (যদিও সেখানে কোভিডে মৃত্যুহার কমছে)। তার একটা কারণ হলো, সেসব দেশে ও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো কোনো কোনো জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসেনি। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিবেশীকে বিপদে রেখে নিজের আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। যতক্ষণ সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ কেউই নিরাপদ নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা