ডায়াবেটিস কিন্তু বহু পুরোনো রোগ। প্রাচীন গ্রিক চিকিত্সকেরাও এই রোগের কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশে একসময় এই রোগকে বহুমূত্র রোগ বলা হতো। উনিশ শতকের দিকে ইউরোপ-আমেরিকায় ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এই রোগের তেমন কার্যকর চিকিত্সা ছিল না তখন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে তখনো ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। এই রোগের কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে জানার জন্য গবেষণায় উঠে-পড়ে লাগলেন পৃথিবীর নানান দেশের বিজ্ঞানীরা।
ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব খাবার খাই, তাতে থাকে প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা ইত্যাদি। এই উপাদানগুলোর রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল। মানবদেহের পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে খাদ্যের এই উপাদানগুলো প্রক্রিয়াজাত হয়ে জটিল রাসায়নিক গঠন থেকে সরল রাসায়নিক গঠনে পরিণত হয়। এসব জটিল রাসায়নিক গঠনকে সরল রাসায়নিক গঠনে রূপান্তর ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এনজাইম ও হরমোন ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন এনজাইম ও হরমোন নিঃসৃত হয় শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি (Gland) থেকে। যেমন অগ্ন্যাশয় (Pancreas) নামের একটি গ্রন্থি আছে। সেটা পাকস্থলীর পাশেই থাকে। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হয় বেশ কয়েকটি হরমোন। এর মধ্যে একটির নাম গ্লুকাগোন (Glucagon), অন্যটির নাম ইনসুলিন (Insulin)। এ দুটি হরমোন রক্তের গ্লুকোজের (Blood suger) পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত করে। রক্তে যদি গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায়, তাহলে গ্লুকাগোন হরমোন নিঃসৃত হয়। এটা গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়াতে কাজ করে। অন্যদিকে, রক্তে যখন আবার গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। ইনসুলিন তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে কাজ করে। গ্লুকাগোন ও ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণকে নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে কাজ করে। যখন কারও শরীরের অগ্ন্যাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন নিঃসৃত হয় না, তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। সেটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো হরমোন থাকে না। একসময় গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়। তখনই সেটাকে আমরা বলি ডায়াবেটিস!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ডায়াবেটিস হয়ে গেল পৃথিবীর এক আলোচিত রোগ। বিজ্ঞানীরা সে সময় নিশ্চিত হলেন, ইনসুলিন নিঃসরণ কমে গেলেই ডায়াবেটিস হচ্ছে। অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে যদি ইনসুলিন প্রবেশ করানো যায়, তাহলে হয়তো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ (Experimental evidence) দরকার। আর সে জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ ইনসুলিন।
অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন আলাদা করার চেষ্টা করছিলেন অনেকেই! কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। এই যখন অবস্থা, তখনই কানাডার এক তরুণ ডাক্তার ফ্রেডরিক বেন্টিং অগ্ন্যাশয় নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। বেন্টিং সদ্য যুদ্ধফেরত ডাক্তার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। রণক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের চিকিত্সা করেছেন। মানুষে মানুষে এই যুদ্ধ, রক্তাক্ত তাঁর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি নিভৃতে মানবসেবার জন্য ব্রত হলেন। বেন্টিং যখন অগ্ন্যাশয় নিয়ে অনেক পড়াশোনা করছেন, তখনই ডায়াবেটিস রোগ নিরাময়ের জন্য কিছু একটা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। বেন্টিং সঠিক সময়ে সঠিক বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকলেন। জানতে পারলেন, তাঁর আগে কয়েকজন ইনসুলিন আলাদা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে বেন্টিং হাল ছাড়লেন না। সমস্যা হলো, তাঁর কোনো ল্যাবরেটরি নেই। তিনি শরণাপন্ন হলেন টরন্টো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিকার্ড ম্যাকলিওডের। ম্যাকলিওড তাঁকে ল্যাবরেটরি দিলেন। সঙ্গে দিলেন একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টুডেন্ট-চার্লস বেস্টকে।
বেন্টিং ও বেস্ট দিন-রাত পরিশ্রম করে গেলেন। একসময় সফল হলেন তাঁরা। তাঁরা সক্ষম হলেন কুকুর ও গরুর বাছুরের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন পৃথক করতে। এবার সেই ইনসুলিন পরীক্ষার পালা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কুকুরের শরীরে ইনসুলিন প্রবেশ করিয়ে দেখলেন, কুকুরটি সুস্থ হচ্ছে। একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করা হলো। কোনো বিষয়কে নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞানে একই পরীক্ষা অনেকবার করা হয়। সময়টা ১৯২২ সাল। বেন্টিং তখন ইতিহাস সৃষ্টির পথে।
বেন্টিং শুধু কুকুরের ওপর পরীক্ষা করেই থামলেন না, নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তুললেন ছোট্ট চিকিত্সালয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের সেখানে চিকিত্সা করতে থাকলেন। রোগীদের শরীরে ইনসুলিন প্রবেশ করিয়ে চলল নিবিড় পর্যবেক্ষণ। দেখলেন, রোগীরা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। বেন্টিংয়ের সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়ল ঝড়ের গতিতে। এগিয়ে এল পৃথিবীর বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ইলি লিলি (Eli Lilly)। বিপুল পরিমাণ ইনসুলিন উত্পাদন করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
১৯২৩ সাল। বেন্টিং ও মেকলয়েডকে চিকিত্সাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর বেন্টিং খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ তাঁকে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করেছে চার্লস বেস্ট। অথচ বেস্টকে নোবেল দেওয়া হয়নি। মেকলয়েড শুধু ল্যাবরেটরির সুবিধা দিয়েই নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। বেন্টিং এর প্রতিবাদও করেছিলেন। কিন্তু নোবেল ঘোষণা বদলায়নি আর। তবে বেন্টিং গড়েছিলেন অনন্য ইতিহাস। নোবেল পুরস্কারের অর্থের অর্ধেক তিনি সেই বেস্টকে দিয়েছিলেন। বড় হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে আরও উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন তিনি।
ইনসুলিন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেল। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে পৌঁছে গেল আমেরিকা ও ইউরোপে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর চিকিত্সাবিজ্ঞানে এক আশীর্বাদের মতো ছিল এই সৃষ্টি। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য মানুষের যন্ত্রণা লাঘব হলো। বেন্টিং তাঁর নাম লেখালেন ইতিহাসের পাতায়। ফ্রেডরিক বেন্টিং এখনো কানাডার হিরো। টরন্টোর সায়েন্স সেন্টারে তাঁকে স্মরণের জন্য আলাদা কক্ষ আছে। টরন্টোতে তাঁর নামে গড়ে তোলা হয়েছে রিসার্চ ফাউন্ডেশন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে বেন্টিং মারা যান। ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাতে অবশ্য কীই-বা আসে-যায়। মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে।
লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত