আমাদের সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রায়ই একটি কথা বলেন, ‘আমরা এখন ফসল খাচ্ছি না, বিজ্ঞান খাচ্ছি।’ অর্থাৎ বিজ্ঞানের কল্যাণে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাতই আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাকে টেকসই করেছে। বিজ্ঞানের তেমনই একটি উদ্ভাবন জিএমও। জিএমও নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বা বিতর্ক বিশ্বব্যাপী।
যদিও এর বেশির ভাগই অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও আবেগতাড়িত। ইংরেজি জিএমওর পূর্ণ রূপ হচ্ছে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম, অর্থাত্ এমন জীব, যার ডিএনএ সিকোয়েন্স পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবর্তনটা হতে পারে অন্য কোনো জীবের জিন অনুপ্রবেশ করানোর মাধ্যমে অথবা নির্দিষ্ট ডিএনএ সিকোয়েন্স বিলুপ্তি ও নতুন ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রতিস্থাপন বা জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে। আর জিএম ফুড হলো জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম থেকে প্রাপ্ত খাদ্য। সয়াবিন, তুলা, সুগারবিট, পেঁপেসহ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শতাধিক জিএমও ফসল বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৭৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জিএম ফসলের চাষ হচ্ছে। বিশ্বে মোট উত্পাদিত ভুট্টা, তুলা, সয়াবিন ও সুগারবিটের ৭০-৯০ শতাংশ আসে জিএমও জাত থেকে। শুধু খাদ্যই নয়, বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধও জিএমও থেকে সংগ্রহ করা হয়। যেমন ডায়াবেটিক রোগীদের অতিপ্রয়োজনীয় রিকম্বিন্যান্ট ইনসুলিন।
কিন্তু জিএম ফুডের প্রয়োজনীয়তা কী? জিএম ফুডের রয়েছে নানা উপকারী দিক। যেহেতু নির্দিষ্ট ডিএনএ সিকোয়েন্সে পরিবর্তন আনা হয়, তাই নির্দিষ্ট পুষ্টিগুণ বাড়ানো সম্ভব। যেমন গোল্ডেন রাইস, যাতে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, যা ভিটামিন ‘এ’-এর প্রিকারসর (বিপাকীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে যে উপাদানটি থেকে পরবর্তীতে অন্য আরেকটি উপাদান তৈরি হয়) এবং এটি খাওয়ার পর মানবদেহে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়া জিএমওর মাধ্যমে ফসলে এমন ধরনের পরিবর্তন আনা হয়, যাতে বিভিন্ন ফলফলাদি দেরিতে পাকে এবং পুষ্ট ও পরিপক্ব হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। বিলম্বে পাকানোর এই টেকনিক কৃষককে বেশি মুনাফা লাভেও সাহায্য করে।
জিএমও ফসলের আরেকটি উপকারিতা হলো সেলফ লাইফ বা স্থায়িত্ব বাড়ানো। অর্থাত্ কোনো ফল বা প্রোডাক্টের লাইফ টাইম বৃদ্ধি করা। যেমন টমেটোর একটি খারাপ দিক হলো এটি অতি দ্রুত পচনশীল। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এমন একধরনের টমেটো তৈরি করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক সময় সজীব থাকে।
ভালো ফসল পাওয়ার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই। অনেক সময় কীটনাশক ব্যবহার করেও ভালো ফলন পাওয়া যায় না। কখনো কখনো বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে মড়ক বা একটি নির্দিষ্ট রোগ ও পোকা দেখা দেয়, যাতে পুরো মাঠের ফসলই নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক সময় ব্যবহূত কীটনাশক ফসলের ক্ষতি করতে পারে। সময় মেনে বালাইনাশক ব্যবহার না করলে এবং বালাইনাশক প্রয়োগের পরপর ফসল সংগ্রহ করলে উত্পাদিত কৃষিপণ্য মানবদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং খুবই কার্যকর। ফসলে রোগ, পোকামাকড় প্রতিরোধী জিন অনুপ্রবেশের মাধ্যমে রোগ ও পোকামাকড় থেকে ফসল সুরক্ষা করা যায়। বর্তমানে এ পদ্ধতি অবলম্বন করে বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী ভ্যারাইটি বা জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (জিই) মাধ্যমে উদ্ভাবিত বিটি বেগুনগাছের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং বিটি আলু লেট ব্লাইট রোগ প্রতিরোধী। অথবা বিটি তুলার অন্যতম পোকা কটন বল ওয়ার্ম প্রতিরোধী। বিটি বেগুন বাংলাদেশে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হচ্ছে, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিটি বেগুনের মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা হচ্ছে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। এই পোকামাকড় গাছে আক্রমণ করলে গাছ থেকে একধরনের প্রোটিন নিঃসৃত হয়, যার ফলে সেগুলো মারা যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, নিঃসৃত প্রোটিন মানুষের কোনো ক্ষতি করে না, যা গবেষণায় প্রমাণিত। ফলে বেগুন ও অন্যান্য ফসল আবাদে যে পরিমাণ কীটনাশক খরচ, তা অনেকটাই সাশ্রয় করছে এই জিএম ফসল।
নিচু জমিতে বর্ষার পানি জমি থাকে। কোনো জমি আবার পানি ধরে রাখতে পারে না। এসব জমিতে চাষাবাদ করা যায় না। এটি সমাধানের জন্য জিইয়ের মাধ্যমে বন্যা ও খরা সহনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন করা হচ্ছে। একইভাবে লবণাক্ত এলাকার জন্য স্যালিনিটি প্রতিরোধী বিভিন্ন জাতের ফসল উদ্ভাবন করা সম্ভব।
বিশ্বের খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি এবং খাদ্যনিরাপত্তা টেকসই করতে জিএম ফসলের বিকল্প নেই। বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে এতে করে একটা সময় সব মানুষের জন্য পরিমাণমতো গুণগত মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাইব্রিড ফসলের পাশাপাশি জিএম ফসলের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
অন্যদিকে জিএমওবিরোধীদের একটি দাবি হলো, যে জিনটা জিএম ফুডে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে, তা অন্য কোনো জীবদেহে স্থানান্তরিত হলে তা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ‘সুপার বাগ’ আর পেস্টিসাইড রেজিস্ট্যান্ট (কীটনাশক প্রতিরোধী) হলে ‘সুপার উইড’ জন্মাতে পারে। আসলে এটি আশঙ্কামাত্র, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনো পাওয়া যায়নি।
আরেকটি অতি সাধারণ অভিযোগ, জিএম ফসল প্রবর্তনের ফলে বীজ কোম্পানিগুলো একক আধিপত্য বিস্তার করবে, যেমনটি হয় হাইব্রিড ফসলের ক্ষেত্রে। কিন্তু এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। কেননা উত্পাদিত জিএমও ফসল থেকে কৃষকই সনাতন পদ্ধতির মতো প্রয়োজনীয় বীজ নিজেই উত্পাদন ও সংরক্ষণ করতে পারেন। ফলে এতে বহুজাতিক বীজ কোম্পানির ওপর নির্ভরতা তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই।
জিএম ফুড নিয়ে এসব ভ্রান্ত ধারণা হয়তো একসময় আর থাকবে না। ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তার বিবেচনায় জিএম ফুডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে, তখন বাংলাদেশ কী করবে তা এখনই ভাবতে হবে। যুদ্ধের ময়দানে নেমে অস্ত্র বানানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা এখনই নেওয়া উচিত। তাই ব্যবহার বা বাণিজ্যিক আবাদ এই মুহূর্তে প্রয়োজন না হলেও আমাদের ভবিষ্যত্ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জাত যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়ম মেনে প্রস্তুত রাখা উচিত। অবশ্য বাংলাদেশ সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। গোল্ডেন রাইস, বিটি কটন ও বিটি পটেটোর বাণিজ্যিক আবাদের সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা।
কৃষিমন্ত্রীকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁকেই দিয়ে শেষ করতে চাই। সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীদের একটি কর্মশালায় তিনি জিএমও ফসল সম্পর্কে বলেছেন, বিশ্বের কোথাও কি জিএমও খেয়ে মানুষ মরেছে এমন উদাহরণ আছে? আসলেই তা নেই। তাহলে কেন এই অযথা বিতর্ক আর জুজুর ভয়? কৃষি ও খ্যাদ্য উত্পাদনে কল্যাণকর প্রযুক্তি এড়িয়ে গেলে আমরা শুধুই পিছিয়ে যাব না, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বিষয়টি আমাদের সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি., গাজীপুর
সূত্র: www.gmo-compass.org
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত