ডাইনোসর শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। এটি একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর নাম। এদের আমরা দেখিনি। কারণ, বিজ্ঞানীদের জানামতে, পৃথিবীতে মনুষ্য প্রজাতির আগমন ঘটেছিল ৪০-৫০ লাখ বছর আগে। অন্যদিকে ডাইনোসর এসেছিল ২৩-২৪ কোটি বছর আগে কোনো এক সময়ে। প্রায় সব মহাদেশেই ছিল এদের সদর্পে বিচরণ। তেমনি ভয়াল ড্রাগন, রূপসী মারমেইড কিংবা অন্য গ্রহের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের এলিয়েন কথা-কাহিনিও আমরা জানি। কিন্তু বাস্তবে আমরা এসবের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না। ড্রাগন-মারমেইড-এলিয়েনের উপস্থিতি অনেকটাই কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু ডাইনোসরের অস্তিত্ব জীবাশ্মভিত্তিক বিজ্ঞান শাখার এক প্রমাণিত সত্য। আজ এদের বিলুপ্ত অস্তিত্ব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
ডাইনোসর শব্দের অর্থ ‘টেরিবল লিজার্ড’ বা ‘ভয়াবহ টিকটিকি’। টিকটিকি তো আমরা সব সময়ই দেখি। পড়ার টেবিলে, ঘরের আনাচেকানাচে, দেয়ালে, সিলিংয়ে। কিন্তু কোনো ডাইনোসর প্রজাতি (যেমন ব্রাঙ্কিয়োসরাস) দৈর্ঘ্যে ৮০ ফুট ও ওজনে ৩৫ টনের (৬-৭টি আফ্রিকান হাতির সমান) হতো। এই প্রাণীগুলো দিনে ৪০০ কেজি খাবার খেত। আর আমাদের প্রতিদিনকার দেখা ২-৩ ইঞ্চি লম্বা টিকটিকি ও ২৩-২৪ কোটি বছর আগেকার বিলুপ্ত ডাইনোসর একই বংশধারার বাহক এবং একই সরীসৃপ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত প্রাণী।
বিবর্তনবিদদের ধারণা, ডাইনোসর ব্যাঙ-জাতীয় (অ্যাম্ফিবিয়া) প্রাণী থেকে ২৮-৩২ কোটি বছরের সময়সীমায় উভচর সরীসৃপ হিসেবে উদ্ভব হয়েছিল।
ডাইনোসর গোষ্ঠীর সব সদস্য যে বিশাল আকার-আকৃতির ছিল, তা নয়। যেমন স্টেগোসরাস দৈর্ঘ্যে ১৩-২৫ ফুট ও ওজনে ১-৪ টন, ইখথায়োসরাস দৈর্ঘ্যে ৩-৪৫ ফুট, আর্কিয়োপটেরিক্স দৈর্ঘ্যে ১৪ ইঞ্চি ও ওজনে ২ পাউন্ড। এগুলোকে কবুতরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই ছোট জাতের ডাইনোসরগুলোর পাখা থাকার কারণে অল্প দূরত্বে উড়ে বেড়াতে পারত। বিবর্তনবিদদের ধারণা, এই দলের প্রাণী থেকেই ভবিষ্যতের পাখি শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে।
ডাইনোসর দলের বিলুপ্তি ও এর কারণ
পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এই বৃহত্ রাজকীয় সরীসৃপগুলো ১০-১২ কোটি (মেসোজোয়িক কাল) বছরের সময়কাল ধরে সদর্পে বিচরণ করেছে। কিন্তু ৬.৬ কোটির (ক্রিটেসিয়াস যুগ) শেষের দিকে এরা টিকে থাকতে পারেনি। দলগতভাবে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে হারিয়ে গেল। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজে আসছেন। তাঁরা নিত্যনতুন অনুকল্প বা হাইপোথিসিস উত্থাপন করে চলেছেন। এর মধ্য থেকে যুক্তিসংগত কিছু ধারণা উত্থাপন করা হলো: এদের স্থূল বৃহদাকার দেহ, বেশি খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা, খাদ্য গ্রহণের প্রতিযোগিতায় অপটু (পরবর্তী সময়ে আগত স্তন্যপায়ীদের তুলনায়), ডিম-শিশু পালনে অদক্ষ ও বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন।
তবে বিশেষজ্ঞ মহল এসবের কোনোটিই ডাইনোসর বিলুপ্তির যথাযথ কারণ বলে মনে করেন না।
নোবেল বিজয়ী (১৯৮০) আলভারেজ ও তাঁর ছেলে ওয়াল্টার একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন। তাঁদের মতে, সাড়ে ছয় কোটি বছরের সময়সীমায় পৃথিবীতে ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি বিশাল উল্কাপিণ্ড এসে পড়েছিল। সেই উল্কাপিণ্ডের প্রবল আঘাতে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে। সেই দুর্ঘটনার কারণে যে ধুলাবালির আস্তরণ তৈরি হয়, তাতে কয়েক বছর পৃথিবীতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারেনি। আলোর অভাবে গাছপালা মরে গিয়ে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এটাই ডাইনোসর গোষ্ঠীর চিরবিলুপ্তির কারণ হয়ে দেখা দেয়। অন্যদিকে অনেক বিজ্ঞানী ‘উল্কাপিণ্ড-পতন’ থিওরিকে সমর্থন করেন না (হিক্কে ও ক্লেমেসন, কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কঙ্কাল বিশেষজ্ঞ)।
তবে ২০১০ সালে ৪১ জন বিজ্ঞানী সম্মিলিতভাবে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আলভেরাজ ও ওয়াল্টারের তত্ত্বকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা ফেলা হয়েছিল, পৃথিবীতে আসা সেই উল্কাপিণ্ডের আঘাতের প্রচণ্ডতা ছিল এর চেয়ে ১০০ কোটি গুণ বেশি শক্তিসম্পন্ন।
ডাইনোসর ফিরিয়ে আনার গবেষণা
ছয় কোটি বছরের সময়সীমায় ডাইনোসরের দলগত চিরবিলুপ্তি ঘটেছিল। এরপর দীর্ঘ সময় চলে গেছে। কিছুদিন থেকে মাঝেমধ্যেই বিজ্ঞানীরা দাবি করে আসছেন, ডাইনোসরকে আবার ফিরিয়ে আনা হবে। এর ওপর ইতিবাচক গবেষণা চলছে। এ ক্ষেত্রে আমিও মনে করি তা সম্ভব। কী করে সম্ভব, তা আমরা আলোচনা করতে পারি। আমরা জানি, প্রতি জীবের কোষ কেন্দ্রকে (নিউক্লিয়াস) ডিএনএ সুতলি থাকে, যা আরেকটি অনুরূপ সুতলি বানাতে পারে। এটাই জীবনের পূর্ব শর্ত, যা প্রতিলিপন (রেপলিকেশন) নামে পরিচিত। সুতরাং প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটি বানাতে হলে এর ডিএনএ লাগবে। সেটা ডাইনোসরের কঙ্কাল বা জীবাশ্ম থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই ডিএনএ বা জেনেটিক বস্তুটিকে কীভাবে সক্রিয় করা যাবে? তাত্ত্বিক বিবেচনায় তা সম্ভব।
তবে দেহকোষ থেকে ক্লোন প্রযুক্তিতে অবিকল জীবন সৃষ্টি এখন জীববিজ্ঞানের একটি প্রতিষ্ঠিত ধারা। এই সূত্র ধরে বিগত কয়েক দশকে ডাইনোসর উদ্ভাবনের গবেষণায় নিয়োজিত বিজ্ঞানী মহল মনে করে, এর সফলতা শুধু সময়ের ব্যাপার। একদিন তৈরি হবে জলজ্যান্ত ডাইনোসর।
লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন; খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত